সিরিয়ায় বহির্বিশ্ব কী করতে যাচ্ছে! by এম আবদুল হাফিজ

সিরিয়ায় প্রায় দেড় বছরের পুরনো 'গৃহযুদ্ধে' হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব সম্প্রদায়ের করণীয় নির্ধারণের বিতর্কও তুঙ্গে। তবে এখনও স্পষ্ট নয় ওই সম্প্রদায়ের মুখপাত্র যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব।


যদিও 'গৃহযুদ্ধ'রত দেশটিতে বহির্বিশ্বের সামরিক হস্তক্ষেপের প্রশ্নটি নিয়ে যথেষ্টই অস্বস্তি রয়েছে, তবু একটা সময় আসবে মানবিক উৎকণ্ঠায় এবং সিরিয়াকে ঘিরে আঞ্চলিক সংকট ঘনীভূত হলে হস্তক্ষেপ ছাড়া উপায় থাকবে না; কিন্তু দেশটিতে এমন অবস্থার সৃষ্টি না হওয়ায় সে সময় উপনীত হয়নি। তবে সিরিয়ায় হস্তক্ষেপে অনীহা না হলেও দীর্ঘসূত্রতার কারণ শুধু এই নয়, হস্তক্ষেপের সপক্ষে পাশ্চাত্যে এখনও জনমতের সৃষ্টি হয়নি।
তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য মহলে বিষয়টি নিয়ে এখনও চলছে বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ। লিবিয়ায় ন্যাটোর বিমান হামলার সাফল্য চলমান হিসাব-নিকাশে অনেকটা স্থান দখল করে রাখলেও সিরিয়ার বাস্তবতা ভিন্ন। অনেক ভিন্ন মুয়াম্মার গাদ্দাফি ও বাসার আল আসাদের ব্যক্তিত্বে। দীর্ঘ সময় ধরে স্থায়ী গাদ্দাফিবিরোধী বিক্ষোভে বেনগাজিতে সমবেত বিদ্রোহীদের নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ঐক্যে কোনো ফাটল ধরেনি এবং গাদ্দাফির অব্যাহত একগুঁয়েমিতে তা আরও দৃঢ় হয়েছে। তার বিপরীতে সিরিয়ায় বিদ্রোহীরা দ্বিধাবিভক্ত।
গাদ্দাফির কোনো সুশৃঙ্খল নিরাপত্তা বাহিনী, প্রশাসন বা নীতি ছিল না। তিনি এক উপজাতীয় নেতার মতো জ্বালানি তেলের পেট্রো ডলারে ভাসছিলেন। একনায়কত্বের পথ ধরে হলেও সিরিয়ায় একটি সুশৃঙ্খল প্রশিক্ষিত নিরাপত্তা বাহিনীসহ দেশে একটি আধুনিক প্রশাসনযন্ত্রের শীর্ষে একটি নীতিনির্ধারক ও পরিচালিত সরকার রয়েছে। 'বিদ্রোহী'দের টার্গেট বাসার আল আসাদ। তার বাবা হাফেজ আল আসাদ কঠিন হাতে দীর্ঘদিন সিরিয়ায় ক্ষমতার শীর্ষে থেকে দেশটিকে সাফল্যের সঙ্গে অনেক দূর এগিয়ে নিতে পেরেছিলেন, যা পাশ্চাত্য জগৎও স্বীকার করে।
পশ্চিমা শক্তির হিসাব-নিকাশে এবং সাম্প্রতিক মূল্যায়নে এ বিষয় পুরনো হলেও আবারও ওপরে উঠে এসেছে। লিবিয়া নয়, বরং সিরিয়াই আরব বিশ্বের রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় খেলোয়াড়, যার নিদর্শন আমরা আগেও দেখেছি লেবাননে দেশটির দীর্ঘ সামরিক দখলদারিত্বে। তাছাড়া ইসরায়েলের প্রশ্নেও সিরিয়া কিছু আপসহীন অবস্থানে আছে। তাই রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক কারণে পশ্চিমা শক্তির মূল্যায়ন অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদের উৎখাত ওই অঞ্চলে আরও ব্যাপক অস্থিতিশীলতার সূচনা ঘটাতে পারে। সিরিয়াকে অযথা আঘাত হেনে ধর্মীয় গোষ্ঠীগত তিক্ততা ইতিমধ্যেই সৃষ্ট অস্থিতিশীলতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তা লেবানন ও ইরাককে উসকে দিয়ে সেখানকার জন্য হুমকিতে পরিণত হতে পারে। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাপার আছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রুশ ও চীনা ভেটোর খৰ উদ্যত হয়েই আছে। তাই সেখান থেকে সিরিয়ায় বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপের সপক্ষে প্রস্তাব পাস হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। নির্বাচনের ডামাডোলে সিরিয়াকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকেও খুব একটা উচ্চবাচ্য নেই।
সেন্টার ফর মিডল ইস্ট স্টাডিজের (ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়) ডিরেক্টর জোসুয়া ল্যান্ডিস বলেছেন, ওবামা প্রশাসনকে সিরিয়ার ব্যাপারে নেতৃত্ব গ্রহণের কোরাস সত্ত্বেও ওবামা এমন নেতৃত্ব গ্রহণের বিরোধী। ওবামার মতে, ওয়াশিংটনকে সিরিয়া সংকটের জটিল আবর্তে নিপতিত না করে মার্কিনদের উচিত, যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক মিত্র সৌদি আরব বা তুরস্কের সিরিয়া নীতিমালাকে অনুসরণ। এতে বোঝা যায়, ওবামা প্রশাসন এ মুহূর্তে সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপে নিরুৎসাহী। জোসুয়া ল্যান্ডিসের মতেও হস্তক্ষেপ করার কোনো শক্তিশালী যুক্তি নেই। এতে আরও বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সিরিয়ার 'গৃহযুদ্ধে' তাদের কোনো জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু জড়িত নেই, থাকলে মার্কিনরা যে কোনো মূল্যে তা উপেক্ষা করতে পারত না।
এদিকে সৌদি আরব সিরিয়ার 'বিদ্রোহী'দের অর্থকড়ি দিয়েই তার দায়িত্ব শেষ করতে চায়। যদিও সৌদি প্রদত্ত অর্থ বিদ্রোহীদের হাতে অপচয় হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তুরস্কের ক্ষেত্রে তাদের দুশ্চিন্তা যতটা না আসাদকে উৎখাত করা, তারও অধিক তুরস্ক সীমান্ত বরাবর সিরিয়া থেকে আতঙ্কে পালিয়ে আসা উদ্বাস্তুদের জন্য সিরিয়ার মধ্যে একটি আশ্রয় কেন্দ্রের সৃষ্টি। বাশার আল আসাদ শিয়াদের একটি ক্ষুদ্র আলুয়িৎ সম্প্রদায়ভুক্ত, যাদের আসাদের জন্য সীমাহীন আনুগত্য। শোনা যায়, আলুয়িৎরা আবার সিরিয়ার খ্রিস্টানদের আনুকূল্যপ্রাপ্ত। তাছাড়া ইরান, ফিলিস্তিনি হামাস ও লেবাননের হিজবুল্লাহ আসাদের শক্তির উৎস। সোভিয়েত আমল থেকেই সখ্যের ভিত্তিতে রাশিয়া আসাদকে অস্ত্র সরবরাহে এখনও উদার। তবু যুদ্ধ যুদ্ধই এবং গৃহযুদ্ধের ক্ষেত্রেও। এর চালিকাশক্তিগুলোও সতত পরিবর্তনশীল। সুতরাং এ সংঘর্ষে শেষ হাসিটি যার ভাগ্যে জুটবে তা শুধু অনুমানেরই ব্যাপার।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.