এপার-ওপার-আকাশ-সম্পর্ক শিথিল by অমিত বসু

ঢাকা থেকে ডানা মেলতে না মেলতেই টুপ করে কলকাতায় নামা। উঠতে-নামতে ১০ মিনিট, উড়াল ৩০ মিনিট। সিটবেল্ট বাঁধতে না বাঁধতেই খোলার পালা। টিফিন যেটুকু দেওয়া হয়, মুখে পোরার সময় থাকে না। ঢাকা থেকে সিলেট, চিটাগাং, বরিশাল যেতে যা সময়, বিমানে ঢাকা-কলকাতা যেতে তার থেকে লাগে একটু বেশি।


প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া সফর মসৃণ। এই আকাশ রুটটা খুব জরুরি, বেড়ানো ও কাজ- দুইয়ের জন্যই। চলাচলটা স্বাভাবিক ছিল, এখন ক্রমেই দুর্লভ। যাত্রী প্রচুর, বিমান কম। যা-ও বা আছে ছোট ছোট। লোক ধরে কম। কোথায় গেল বড় বড় এয়ারক্র্যাফট! একের পর এক বিমান কম্পানি ভ্যানিশ। ভাটার টান কেন? এমন তো নয়, যাত্রী কম বলে লোকসান হচ্ছিল। যোগাযোগ যেখানে বাড়ানো দরকার, সেখানে কমার লক্ষণ বিস্ময়কর।
জোগান কমলে চাহিদা বাড়ে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে মূল্যবৃদ্ধি। আকাশ ভ্রমণের মাসুল আকাশছোঁয়া। যে টিকিটের দাম ছিল ভারতীয় মুদ্রায় তিন হাজার, সেটা বেড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার। প্রায় দ্বিগুণ। শেয়ারবাজারের মতো টিকিটের দামের ওঠানামা, তাদের লাগাম পরানোর কেউ নেই। বিমান পরিষেবায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ উঠে যাওয়ার পর সংস্থাগুলোর পোয়াবারো। এর মানে এই তো নয়, বিমানে যাঁরা সফর করেন, তাঁদের পকেট কাটার পূর্ণ স্বাধীনতা।
তেলের দাম বাড়লে টিকিটের মূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পেতেই পারে। বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশেই বিমান পরিষেবা বেসরকারি হাতে। সরকারি দায়িত্বে ক্ষতির খতিয়ান বেড়েছে। এর অজুহাতে হাত ধুয়ে ফেলেছে সরকার। তাতেই কি সরকারি দায় থেকে অব্যাহতি আছে? সাধারণের সুবিধা-অসুবিধের কথা ভাবতে হবে না!
বেসরকারীকরণের বিপদ যেমন, লাভও তেমন। তীব্র প্রতিযোগিতায় ভাড়া কমে, স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ে। প্রথমদিকে তেমনটাই হয়েছিল। সুবিধা সমুদ্র সৈকতের বালু থেকে সহজলভ্য। টিকিটের দাম কাগজের থেকে কম। বিমান কম্পানিগুলোর ডাকাডাকিতে যাত্রীদের কান ঝালাপালা। কে কোন ফ্লাইটে পা রাখবে ভেবে অস্থির। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত পরপর ফ্লাইট। একটা মিস করলে আরেকটা। আকাশে ওঠানামা সহজ। আগে থাকতে টিকিট বুকিংয়ের দরকার নেই। এয়ারপোর্টে গিয়ে টিকিট কেটে প্লেনে উঠে পড়া। এ রকমটা আর কিছুদিন চললে বিমানে বসে টিকিট কাটার সুযোগ এসে যেত হয়তো। আমেরিকার ডমেস্টিক ফ্লাইটে যেমনটা প্রচলিত। এ ব্যবস্থা আমাদের মতো দেশে বাস পরিষেবা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে উঠে টিকিট কাটার পদ্ধতি চালু করা কঠিন। অসম্ভব নয়। দূরের দেশে যেতে ঝক্কি অনেক। যে দুটি দেশ গায়ে গায়ে ছুঁয়ে আছে, যে দুই শহরের দূরত্ব ৪০০ কিলোমিটারের কম, সেখানে আকাশবন্ধন যত সরল হয়, ততই ভালো। দুটি দেশ পাশে থাকুক, সুখে-দুঃখে মিশে থাকুক। একই আকাশে-বাতাসে শ্বাস নিক ভালোবাসার।
এই রাস্তায়ই হাঁটছিল কিংফিশার কম্পানি। বুকিংয়ের জন্য ফোন করলেই বলত, 'কবে যাবেন শুধু বলুন। নিশ্চিন্তে পেঁৗছে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের।' টিকিটের দাম জানতে চাইলে স্মিত হাসি, সরল উত্তর, 'দাম নিয়ে ভাববেন না। আমরা তো আছি।' সত্যি তা-ই। অবিশ্বাস্য সস্তায় কলকাতা থেকে তুলে নিয়ে ঢাকায় ফেলত। আবার ঢাকা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে কলকাতায় নামিয়ে দিত। বেসরকারীকরণের পুরস্কার হাতেনাতে। মনে হলো, এবার বিমান বাস-ট্রেনের সঙ্গে লড়তে নামবে। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিমান পরিবহনে অনেকটা সেটাই হয়েছে। বিমানভাড়া প্রায় ট্রেনের এসি ফার্স্ট ক্লাসের সমান। অজস্র বিমান সংস্থার মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি ফ্লাইট। কেউ কারো জন্য এক ইঞ্চি জমি ছাড়বে না। সব কম্পানি মুড়ি-মিছরির মতো ছড়াচ্ছে বিমানের টিকিট। প্রলুব্ধ করছে, উদ্বুদ্ধ করছে, তাদের উড়ালে সওয়ার হতে।
কিংফিশার ঠিক এটাই করতে চেয়েছিল, ঢাকা-কলকাতা ফ্লাইটেও। করেও ছিল অনেকটা। শেষ রফা হলো না। আচমকা ছিটকে গেল। তাদের অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচলও চোরাবালিতে পড়ল। নিমেষে নিশ্চিহ্ন। কর্মচারীদের কপালে আগুন। মালিক বিজয় মানিয়া অসহায়। ঋণের পাহাড়ে সমাধিস্থ।
একই পরিণতি আরো অনেকের। আগে গেলে বাঘে খায়, পরে গেলে রাজা হয়- কথাটা তাদের ক্ষেত্রে সর্বাংশে সত্যি। ব্যবসাটা হারজিতের খেলা। হারতে হারতে যে জেতে সে বাজিগর। সব স্বপ্নের একটা বাস্তব ভিত থাকা দরকার। নইলে স্থায়ী সাফল্যেই শক্ত জমি খুঁজে পাওয়া কঠিন। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই। অতিরিক্ত তাড়াতাড়ি করাটা বাড়াবাড়ি। বেশি কাড়াকাড়িতে দাঁড়ি পড়ে দ্রুত।
জিএমজি এয়ারলাইনসও শুরুটা করেছিল ভালো। দিব্যি চালাচ্ছিল। কিছুটা চমকের পর আচমকা বিরতি। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হতেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় যখন বাংলাদেশ বিমানের প্রতিষ্ঠা হয়, তখনই একাই ঢাকা-কলকাতার আকাশে ওড়াওড়ি করত। নামমাত্র ভাড়ায় এ দেশ-সে দেশ। বিদেশ যাত্রার স্বপ্ন যাদের অপূর্ণ থাকত, তারা ঢাকা-কলকাতা যাতায়াত করে সেই সাধ মেটাত। জার্নি একটুখানি হলে কী হবে, তোড়জোড় অনেক। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পাসপোর্ট-ভিসা জোগাড় করে তবে বিদেশ যাওয়ার দিশা খোঁজা। বিমানে কোনো শ্রেণীবিন্যাস ছিল না। এমনিতে ক্লাব ক্লাসের যাত্রীরা সামনে বসবে। তাদের পেছনে থাকবে পর্দার পাঁচিল। এরপর ইকোনমি ক্লাসের প্যাসেঞ্জাররা। বাংলাদেশ বিমানে সেই বিভেদ দেখা যায়নি। পথে ছোট ক্র্যাফট ফকারের জায়গায় এয়ারবাস বা ডিসি ট্রেনের মতো অতিকায় বিশাল যাত্রীসেবা শুরু করায় বিভেদ বহাল হয়।
ধীরে ধীরে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস বাংলাদেশ বিমানের সঙ্গী হয়। এটি ছিল সম্পূর্ণ ডমেস্টিক ফ্লাইট। দেশের মধ্যেই ওড়াওড়ি করত। প্রতিবেশী দেশের ডাকে লোভ সামলাতে পারেনি। ঢাকা-কলকাতার নতুন আকাশ সেতু হয়ে উঠতে সময় নেয়নি। তাতে চড়ার ব্যক্তিগত সুবিধা ছিল আমার। ইকোনমি ক্লাসের টিকিট আপগ্রেড করে বিজনেস ক্লাসে বসিয়ে দিত। একদিন তারাও রইল না। এয়ার ইন্ডিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজের অস্তিত্ব হারাল।
মাঝখানে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস সিঙ্গাপুর যাওয়ার ফাঁকে ঢাকা ছুঁয়ে যেত। এয়ার ইন্ডিয়া লন্ডন যেতে ঢাকা স্পর্শ করত। আস্তে আস্তে বিমান পরিষেবায় এলো আমূল পরিবর্তন। গোটা ব্যবস্থাটাই বেসরকারি হাতে চলে গেল। প্রথমদিকে চলছিল ভালোই। দিনের ভাগে থাকে পনেরোটা ফ্লাইট। যাত্রীরা যাত্রার ইচ্ছামতো সময় বেছে নিতে পারত। ছোট ছোট অনেক বিমান কম কম করে যাত্রী আনা-নেওয়া করত। পরিষেবায় আচমকাই বিভ্রাট। বাণিজ্যিক বিপদে যাত্রীরাও বিপর্যস্ত।
আমার কথা একটাই, পুরনোরা যতই পাততাড়ি গোটাক, নতুনদের উৎসাহ কিন্তু কমছে না। নতুন নতুন বিমান সংস্থা শূন্যস্থান পূরণে আগ্রহী। বাংলাদেশের বিমান সংস্থা রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা-কলকাতা উড়াল চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আপাতত ৫০ আসনের ছোট বিমান চালাবে। পরে বড় বিমান ভাড়া করবে। সেটাই তো ভালো। ছোট থেকে বড় হলে ভিত শক্ত থাকবে। ঝড়ঝাপটায় কাত হবে না। সব প্রতিকূলতা আত্মসাৎ করে উড়াল অব্যাহত রাখতে পারবে। অনুজকে দেখে অগ্রজরা বল পাবে। সাহসে ভর করে ফিরে আসার সংকল্প নেবে।
লেখক : কলকাতার সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.