জেএমবির বোমা হামলার সাত বছর-বিচার শেষ হয়নি ৬৮ মামলা by ওমর ফারুক ও কে এম সবুজ

সাত বছর আগে এই দিনে সারা দেশের মানুষ কেঁপে উঠেছিল সিরিজ বোমা হামলায়। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সকাল ১০টা থেকে দুপুর পৌনে ১২টার মধ্যে মুন্সীগঞ্জ ছাড়া দেশের ৬৩ জেলার সাড়ে চার শতাধিক স্থানে প্রায় পাঁচ শ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) জঙ্গিরা।


এ ঘটনায় সারা দেশে ১৫৯টি মামলা করা হয়। যার মধ্যে ৬৮টি মামলার বিচারকাজ এখনো শেষ হয়নি।
বোমা ফাটানো হয়েছিল রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাব, আদালতপাড়া, সুপ্রিম কোর্ট, বিমানবন্দরসহ ৩৩টি স্থানে। জেলা শহরগুলোতে হামলা চলে একই সময়ে। ওই হামলার মধ্য দিয়ে জেএমবি তাদের শক্তির জানান দেয়। বোমা হামলায় নিহত হয় দুজন। আহত হয় শতাধিক। সিরিজ বোমা হামলার পর ধারাবাহিকভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মঘাতী হামলা চালায় জেএমবি। এসব হামলায় বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ ৩৩ জন নিহত হন। আহত হন চার শতাধিক লোক। জেএমবির বোমা হামলায় অনেকে পঙ্গু হয়ে যান।
র‌্যাব সূত্রে জানা যায়, ১৭ আগস্ট জেএমবির হামলার ঘটনায় সারা দেশে ১৫৯টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে ৯১টি মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে। বিচারাধীন আছে ৬৮টি। এসব মামলায় আসামি করা হয় ৭৪৭ জনকে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫৪৮ জনকে। মামলা থেকে খালাস পেয়েছে ১১৪ জন। পলাতক রয়েছে ৬৪ জন। বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পেয়েছে ২৪২ জন। বর্তমানে ২১ জন আসামি জামিনে রয়েছে। ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন থানায় মামলা হয় ১৮টি।
র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের প্রধান কমান্ডার এম সোহায়েল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সব পলাতক আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি আমরা।'
১৭ আগস্ট বোমা হামলার ঘটনার আড়াই মাস পর ২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর জেএমবি ঝালকাঠিতে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে দুই বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ে ও সোহেল আহমেদকে হত্যা করে। এ মামলায় ঝালকাঠির আদালতেই জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ, ইফতেখার হাসান আল মামুন ও আসাদুল ইসলাম আরিফের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ হয়। আরিফ পলাতক থাকায় অন্য ছয়জনের ফাঁসি ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ মধ্যরাতে পাবনা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও কাশিমপুর কারাগারে কার্যকর করা হয়। ২০০৭ সালের ১৪ জুলাই আরিফকে ময়মনসিংহ থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। আপিল করায় তার দণ্ডের বিষয়টি এখনো ফয়সালা হয়নি।
ওই বিচারের প্রতিশোধ নিতে জেএমবি ২০০৭ সালের ১১ এপ্রিল মামলা পরিচালনাকারী তৎকালীন পিপি হায়দার হুসাইনকে গুলি করে হত্যা করে। এ মামলাটিও বর্তমানে ঝালকাঠির আদালতে বিচারাধীন।
সারা দেশে এই জঙ্গি তাণ্ডব শুরুর পর জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমানসহ শীর্ষ সাত শুরা সদস্যকে গ্রেপ্তারের জন্য মাঠে নামে র‌্যাব। শায়খ আবদুর রহমানকে গ্রেপ্তারের জন্য রাজধানীসহ দেশের একাধিক স্থানে অভিযান চালায় তারা। অবশেষে ২০০৬ সালের ২ মার্চ সিলেটের পূর্ব শাপলাবাগ এলাকার 'সূর্য দীঘল বাড়ি' নামের একটি বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এর চার দিন পরই ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার রায়পুর থেকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করে জেএমবির সেকেন্ড ইন কমান্ড বাংলা ভাইকে। জেএমবির শুরা সদস্য মো. রকিব হাসান ওরফে হায়দারকে ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বাইতুল মোকাররমের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লাইব্রেরি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। চট্টগ্রাম থেকে একই বছরের ২৫ এপ্রিল গ্রেপ্তার করা হয় আরেক শুরা সদস্য মো. সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ওরফে সজীব ওরফে তাওহীদকে। আরেক শুরা সদস্য খালেদ সাইফুল্লাকে ডেমরার কোনাবাড়ী থেকে এবং আতাউর রহমান সানিকে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। শীর্ষ সাতজনের অন্য দুজনের মধ্যে মোহতাসিম বিল্লাহ ওরফে বশিরকে ২০০৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কোনাবাড়ী ও মেহেদী হাসান ওরফে আবীর ওরফে তানভীর ওরফে মুশফিককে ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের আড়িয়াব গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
১৭ আগস্ট বোমা হামলার পর আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ দায়িত্ব স্বীকার না করলেও প্রতিটি বিস্ফোরণ স্থানে নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামী জঙ্গি সংগঠন জেএমবির নামে বাংলা ও আরবি ভাষায় লেখা লিফলেট পাওয়া যায়। সেই লিফলেটে ইসলামী আইন বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়। পরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শতাধিক ব্যক্তিকে। তাদের মধ্য থেকে প্রথম সাতক্ষীরার দুই সদস্য স্বীকার করে যে এ ঘটনা জেএমবিই ঘটিয়েছে। এর পেছনে পরিকল্পনা ও আর্থিক সহযোগিতা ছিল দলের আমির শায়খ আবদুর রহমানের।
শীর্ষ জঙ্গিনেতা শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইকে ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার পর বাইরে থাকা জঙ্গিরা প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ২০০৭ সালের ৯ জুলাই ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার তিতলিয়া গ্রামের মাদ্রাসা শিক্ষক ও র‌্যাবের সোর্স আনোয়ারকে গুলি করে হত্যা করে সাগর হোসেন ওরফে সায়েম ও সাইফুল ইসলাম নামের দুই জেএমবি সদস্য। সাগর হোসেন ও সাইফুল ইসলামকে স্থানীয় জনগণ ধাওয়া করে ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে।
জামালপুরে শায়খ আবদুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে গঠিত হয় জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ নামের জঙ্গি সংগঠন। অভিযোগ রয়েছে, গত জোট সরকারের আমলে বাংলা ভাইয়ের উত্থান ঘটে রাজশাহী অঞ্চলে। জেএমবি আত্মপ্রকাশ করার পর সরকারের পক্ষ থেকে তাদের দমন করতে পদক্ষেপ না থাকলেও একযোগে সারা দেশে বোমা হামলা চালানোর পর সরকারের টনক নড়ে। জেএমবিকে ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
ঝালকাঠিতে বিচার শেষ হয়নি
ঝালকাঠিতে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বোমা হামলার ঘটনায় মামলা হয় দুটি। দীর্ঘ সাত বছর পার হলেও দুটি মামলার একটিরও বিচারকাজ শেষ হয়নি। এমনকি সাক্ষ্যগ্রহণও শুরু হয়নি। বর্তমানে ঝালকাঠির বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-২ আদালতে মামলা দুটিতে সাক্ষ্যগ্রহণের অপেক্ষায় রয়েছে। সরকারপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী অতিরিক্ত পিপিএম আলম খান কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, মামলার বাদী ঝালকাঠি থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহরাব আলী ইন্তেকাল করায় কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তবে ইতিমধ্যে সে সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা খুঁজে পাওয়া গেছে। মামলা দুটিতে মোট ১৫ জন সাক্ষী রয়েছে এবং শিগগিরই তাদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
১৭ আগস্ট সকাল সাড়ে ১১টার দিকে পর পর পাঁচটি বোমার বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ঝালকাঠি শহর। বোমার বিস্ফোরণ ঘটে জেলা জজ আদালত চত্বর, জেলা প্রশাসক কার্যালয়, আইনজীবী সমিতি, সদর উপজেলা পরিষদ চত্বর ও বিকনা টেম্পোস্ট্যান্ডে। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে বিস্ফোরণে সাংবাদিক দুলাল সাহা ও পুলিশসহ ছয়জন আহত হয়। উপজেলা পরিষদ চত্বরে আহত হয় বোমার বাহক রিকশাচালক ফরিদ হোসেন। ঝালকাঠি থানার তৎকালীন ওসি মো. সোহরাব আলী বাদী হয়ে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি মামলা করেন। দুটি মামলাতেই আহত অবস্থায় আটক ফরিদ হোসেনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০০৬ সালের ২২ অক্টোবর গোয়েন্দা পুলিশ দুটি মামলাতেই চার্জশিট দাখিল করে। জেএমবির সদস্য ঝালকাঠির বিকনা গ্রামের মো. জিয়াউর রহমান ও আহত অবস্থায় আটক রিকশাচালক ফরিদ হোসেনকে চার্জশিটে আসামি করা হয়। ঘটনার দুই বছর পর অভিযুক্ত ফরিদ হোসেন আদালত থেকে জামিন লাভ করে। অপর অভিযুক্ত জিয়াউর রহমান বর্তমানে কারাগারে রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.