পাট খাতের দুর্বলতা সরকারি দুর্বলতারই প্রতিফলন- পাটের এদিন-সেদিন

রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক সংকট, গৃহযুদ্ধ এবং বড় যুদ্ধেও ডামাডোলের অন্যতম শিকার বাংলাদেশের পাটচাষিরাও। দেশে চাহিদা নেই, আবার প্রধান রপ্তানি-গন্তব্য ইরান, মিসর, সিরিয়া ও লিবিয়া পাট নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে।


অবস্থার ফেরে পড়ে, মাথা চাড়া দিতে চাওয়া পাট খাত আবারও হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। অতীতে সরকারি অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির জন্য শক্তিশালী পাটশিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছিল। সেই মুমূর্ষু পাট খাতের জন্য দরকার ছিল সুদূরপ্রসারী ও বহুমুখী পরিকল্পনা। কিন্তু সকলই গরল ভেল। মাঝখান থেকে পাটচাষির মাথায় হাত।
পাটের বিকাশ আর বাংলার বিকাশ একসময় একই অর্থ বহন করত। পাটের সেই সুদিন কেবল গতই হয়নি, এখনো পাট চাষ, পাটশিল্প এবং পাটচাষিরা চরমভাবে উপেক্ষিত। এই সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে পাট খাতের পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ নেয়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারেও সে সময় পাট ও পাটজাত তন্তুর চাহিদা ভালোভাবেই বেড়েছিল। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সম্ভব ছিল পাট খাতকে শক্ত মেরুদণ্ডের ওপর দাঁড় করানো। দুইভাবে তা করা সম্ভব ছিল: এক, দেশের ভেতরে পাটের উৎপাদন বাড়ানোয় চাষিদের উৎসাহিত করা এবং উৎপাদিত পাটকে কেন্দ্র করে ছোট-বড় পাটভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা। অন্যদিকে, বিদেশে বাংলাদেশি পাটের বাজার প্রসারিত করা এবং বিদেশি চাহিদা মোতাবেক পাটজাত পণ্য তৈরি করা। দুটি ক্ষেত্রেই পাট মন্ত্রণালয়ের উল্লেখযোগ্য সাফল্য নেই। এমনকি আইন করে যেসব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যে ৭৫ শতাংশ পাট আছে এমন মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। কিন্তু কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। আইন আছে আইনের জায়গায়, বাস্তবায়ন নেই। এসবেরই সম্মিলিত ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে পাটচাষিদের।
দুই বছর ধরে ক্রমাগত লোকসানে ক্লান্ত ও পর্যুদস্ত পাটচাষিরা। অথচ তিন বছর ধরে টানা পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ ও আয় বেড়েছিল। গত বছরও দাম কমের বাস্তবতাতেও মণপ্রতি পাট বিক্রি হয়েছে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায়। এবার সেই পাট বিক্রি হচ্ছে দেড় হাজার টাকারও কম দামে। এ অবস্থায় চাষিরা এ বছর পাট চাষের মাত্রা কমিয়ে দিয়েছেন। গত বছরের বিক্রি না হওয়া পাটের পাশাপাশি এ বছর উৎপাদিত পাটও পড়ে থাকছে। মধ্যপ্রাচ্যে সংকট চলছে দুই বছর যাবৎ। দেশের পাটকলগুলোর লোকসানি কার্যকলাপও অজানা নয়। এ অবস্থায় পাটচাষিদের জন্য পাট ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের রক্ষামূলক ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন ছিল।
বাংলাদেশের পাট বিশ্বমানের, বাংলাদেশের পাটশিল্পের অভিজ্ঞতা শতবর্ষ পুরোনো, বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জিনকোড আবিষ্কারের কৃতিত্বও দেখিয়েছেন। অথচ সেই বাংলাদেশেই পাট এক বিড়ম্বনা ও লোকসানের অপর নাম হয়ে আছে। পাটের বিকাশের গোড়া কৃষকের হাতে হলেও এর আগায়, অর্থাৎ সরকারি ব্যবস্থাপনায় পচন ধরেছে। পাটের দুর্দিন শেষ না হওয়ার সেটাই কারণ।

No comments

Powered by Blogger.