জঙ্গিবাদের উত্থানের ভয়ংকর রূপ by ড. মিল্টন বিশ্বাস

জাতীয় শোক দিবসের মাস আগস্ট। কিন্তু এ মাসজুড়ে রয়েছে গ্রেনেড ও বোমা হামলার মতো মর্মান্তিক ঘটনা এবং জঙ্গিবাদের উত্থানের ভয়ংকর দৃষ্টান্ত। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন


শতাধিক নেতা-কর্মী গুরুতর আহত হন; নিহত হন আওয়ামী মহিলা লীগের নেতা ও বর্তমান রাষ্ট্রপতির সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২৪ জন। বিশ্বজুড়ে তোলপাড় করা গ্রেনেড হামলার সেই ঘটনার ভয়াবহতা আমাদের হতবাক করে দিয়েছিল। পরের বছর ঠিক একই মাসের ১৭ তারিখে দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে পাঁচ শতাধিক বোমা বিস্ফোরণ ও নিহত মানুষের স্বজনদের আর্তনাদ এবং আহত মানুষের কান্নায় আমাদের মনে ক্ষোভ ও ঘৃণা আরো তীব্র হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বোমা হামলার ভয়ংকর ঘটনাগুলো শুরু হয়েছিল তারও আগে থেকে। ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরের টাউন হল মাঠে উদীচীর সমাবেশে বোমা হামলায় নিহত হয় ১০ জন। একই বছরের ৮ অক্টোবর খুলনার নিরালা এলাকায় অবস্থিত কাদিয়ানিদের উপাসনালয়ে বোমা বিস্ফোরণে আটজন নিহত হয়। ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে সিপিবির মহাসমাবেশে বোমা হামলায় ছয়জন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হয়। ১৪ এপ্রিল রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবে সংঘটিত বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ১১ জন। ৩ জুন বোমা হামলায় গোপালগঞ্জের বানিয়ারচর গির্জায় সকালের প্রার্থনার সময় নিহত হয় ১০ জন; আহত হয় ১৫ জন। সিলেটে একাধিক বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া নিহত হন গ্রেনেড হামলায়। ২০০৪ সালের ২১ মে হজরত শাহজালাল (রহ.) মাজার পরিদর্শনে গেলে গ্রেনেড হামলায় আহত হন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সমাবেশে, অফিসে, নেতার গাড়িতে, সিনেমা হলে একাধিক বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে বোমা ও গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছে শতাধিক ব্যক্তি। অথচ ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট এ ধরনের তৎপরতা বন্ধে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। হামলা প্রতিরোধ ও জঙ্গি দমনে তৎকালীন সরকারের নিষ্ক্রিয়তা জঙ্গিবাদ উত্থানে সহায়ক হয়ে উঠেছিল। বর্তমান সরকারের সময় সেই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। এ জন্য এই বছর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এ দেশ সফরে এসে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের অবস্থানের প্রশংসা করে গেছেন।
তবে দেশের মধ্যে জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা এখনো অব্যাহত রয়েছে। ১৩ আগস্ট রাজধানীর পান্থপথের একটি রেস্তোরাঁ থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহ্‌রীরের ৩৫ সদস্য গ্রেপ্তার হলো। অর্থাৎ গোপনে সংগঠিত হচ্ছে হিযবুত তাহ্‌রীর। ব্যাপক ধরপাকড়ের মধ্যেও থেমে নেই উগ্রপন্থীদের কার্যক্রম, বরং গোপনে নতুন সদস্য সংগ্রহ ও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি চালাচ্ছে তারা।
অধ্যাপক আবুল বারকাতের লেখা 'বাংলাদেশে মৌলবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি' প্রবন্ধ এবং জঙ্গিবাদের উত্থান সম্পর্কিত কয়েকটি গ্রন্থ পাঠ করে দেশের মধ্যে ২০০৪ সালের ভয়াবহ গ্রেনেড ও ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার নেপথ্যের চক্রান্ত ও সন্ত্রাসী রাজনীতির পূর্বাপর ইতিহাস আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে যে পাকিস্তানবাদী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির তৎপরতা শুরু হয়েছিল, এরই অনিবার্য ফল হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের উত্থান। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় মৌলবাদী রাজনৈতিক সংগঠনের অপরাজনীতি শেকড় গেড়ে বসে। উল্লেখ্য, ক্ষমতা গ্রহণের পর সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া ১৯৭৬ সালে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি উন্মুক্ত করতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন (বিশেষ অধ্যাদেশ ৪ মে ১৯৭৬ এবং বাংলাদেশ সংবিধান, পঞ্চম সংশোধনী, ২২ এপ্রিল ১৯৭৭)। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব জামায়াতের রাজনীতি শুরু হয় এবং ইসলামী ছাত্রসংঘের কতিপয় নেতা ১৯৭৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সমবেত হয়ে পরিবর্তিত নাম 'ইসলামী ছাত্রশিবির' ধারণ করে নতুনভাবে কর্মকাণ্ড শুরু করে। এদের মূল উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের মতো বাংলাদেশকে পরিচালনা করা। এ লক্ষ্যে শিবির দেশের ছাত্র ও যুবসমাজের মধ্যে গভীরভাবে প্রবেশের পরিকল্পনা করে। ১৯৮০-এর দশকে আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধে আমেরিকা ও পাকিস্তান আফগানিস্তানকে সহায়তা করে। আফগানিস্তানের পক্ষে শিবিরের সদস্যসহ বেশ কিছু বাংলাদেশি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এরা পাকিস্তানে আইএসআইয়ের এবং আফগানিস্তানে তালেবানদের অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিল। পরে এদের মধ্যে কিছুসংখ্যক বাংলাদেশি ফিলিস্তিন ও চেচনিয়া যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছে। এরা প্রায় সবাই বাংলাদেশে ফিরে আসে। এসব যুদ্ধফেরত সদস্যই পরে বাংলাদেশে আইএসআই, তালেবান ও আল-কায়েদার স্থানীয় সদস্য হিসেবে এ দেশে আইএসআই, এলইটির (লস্কর-ই-তৈয়বা) এজেন্ট হিসেবে গণ্য হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় তাদের কার্যক্রম গোপনে চলতে থাকে ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনামলেও। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৬ পর্যন্ত দেশজুড়ে জঙ্গিবাদের বিস্ময়কর উত্থান বিশ্ববাসীকে হতবাক করে। কারণ জোট প্রশাসন জঙ্গিদের প্রত্যক্ষ সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিল। ২০০৫ সালে দেশব্যাপী বোমা বিস্ফোরণের কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। সে সময় বিদেশি পত্রিকা থেকে আমরা জেনেছিলাম, লাদেন এ দেশে এসেছিলেন। শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার কথা এ সূত্রে মনে রাখা দরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ যে শীর্ষ জঙ্গিদের ফাঁসি কার্যকর করে, তাদের সবারই জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই অতীতে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৫ জুন ২০০৭ সালে দৈনিক পত্রিকা থেকে জানা যায়, গ্রেপ্তারকৃত কয়েকজন জেএমবি সদস্য অতীতে জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছে। ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত হরকাতুল জিহাদের প্রধান মুফতি হান্নান তাঁর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে হামলার সঙ্গে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, লুৎফুজ্জামান বাবর এবং ইসলামী ঐক্যজোট নেতা মুফতি শহিদুল ইসলামের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। 'ইসলামী সমাজ', 'আল্লাহর দল' বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন। জামায়াতে ইসলামীর একাংশ বের হয়ে তৈরি হয়েছিল 'ইসলামী সমাজ' আর 'আল্লাহর দলের' প্রতিষ্ঠাতা ছিল ছাত্রশিবিরের কর্মী। শীর্ষ নেতারা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের সম্মুখীন হওয়ায় প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ভিন্ন পন্থার অনুসন্ধান চলছে জামায়াত-শিবিরের ভেতর। তারা এখন 'হিযবুত তাহ্‌রীর উল্লাইয়াহ বাংলাদেশ', 'হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী বাংলাদেশ' (হুজি)সহ আরো অনেক জঙ্গি সংগঠনকে তাদের পতাকাতলে একত্রিত করেছে। অবশ্য বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 'ইসলামী মৌলবাদী' দল হিসেবে চিহ্নিত করেছে জামায়াতে ইসলামীকে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থের লেনদেন ও সন্ত্রাসবাদে অর্থের জোগানে সহযোগিতা দেওয়ার মতো অপরাধের সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনা হয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে এ দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য ইসলামী দেশের পার্থক্য রয়েছে। এখানকার ইসলাম ধর্মানুসারীরা উদার ও মানবিক। হাজার বছর ধরে অন্যান্য ধর্ম বিশ্বাসীরা এখানে নির্বিঘ্নে বাস করে আসছে। এ জন্য ধর্মভিত্তিক সাম্প্র্রদায়িক জঙ্গিরা জোর করে ক্ষমতা দখল করতে পারবে না। উগ্রপন্থীরা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার নেতৃত্বকে নিঃশেষ করতে চেয়েছিল। তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। পরের বছর সিরিজ বোমা হামলার মাধ্যমে দেশকে তালেবান রাষ্ট্র বানানোর ষড়যন্ত্রও নস্যাৎ হয়েছে। বর্তমান সরকারের জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান ইতিমধ্যে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আমাদের মতো খ্রিস্টান সম্প্রদায়সহ অন্যান্য ক্ষুদ্র ধর্ম বিশ্বাসীরাও নিরাপদে এ দেশে বসবাসের নিশ্চয়তা পাবে। সাম্প্রদায়িক ও অনগ্রসর-পশ্চাৎপদ দৃষ্টিভঙ্গির চূড়ান্ত পরিণতির নাম জঙ্গিবাদ। দেশ থেকে এ ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা চিরতরে বন্ধ হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
email- writermiltonbiswas@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.