১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলার সপ্তম বার্ষিকী আজ- এখনো বিচারাধীন ৬৮ মামলা

‘১৭ আগস্ট দুপুর ১২টার পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বোমা বিস্ফোরণের খবর আসতে থাকে। দায়িত্বশীলেরা মোবাইল ফোনে এসব খবর দেয়। আমি শুনে বলি আলহামদুলিল্লাহ।’ গ্রেপ্তারের পর টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেলে এভাবেই দেশব্যাপী বোমা হামলার বিবরণ দিয়েছিলেন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের


(জেএমবি) সামরিক শাখার তৎকালীন প্রধান আতাউর রহমান ওরফে সানি। তিনি ছিলেন ওই বোমা হামলার সমন্বয়ক। জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমানের ছোট ভাই সানিকে ২০০৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব।
আজ ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলার সপ্তম বার্ষিকী। ২০০৫ সালের এই দিনে ৬৩টি জেলায় একযোগে প্রায় ৫০০ বোমা ফাটিয়ে জঙ্গি সংগঠন জেএমবি প্রচলিত শাসন ও বিচারপদ্ধতি বাতিল করে ‘আল্লাহর আইন কায়েমের’ দাবি জানিয়ে প্রচারপত্র ছড়ায়।
র‌্যাব ও পুলিশ সূত্র জানায়, ১৭ আগস্ট বোমা হামলার ঘটনায় সারা দেশে ১৫৯টি মামলা হয়। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ৭৪৭ জন। তাঁদের মধ্যে ৬৪ জন এখনো পলাতক। এর মধ্যে ৯১টি মামলার রায় হয়েছে। তাতে ২৪২ জনের সাজা হয়েছে। বিচারে অব্যাহতি পান গ্রেপ্তার হওয়া ১১৪ জন। বাকি ৬৮টি মামলা বিচারাধীন।
জেএমবির ব্যাপারে শুরুতে বেশ উদাসীন ছিল তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার। দেশব্যাপী বোমা হামলার পর সরকারের টনক নড়ে। এরপর জেএমবিবিরোধী অভিযান শুরু করে। পরে ২০০৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে পরের বছরের ২৬ এপ্রিলের মধ্যে শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ জেএমবির শীর্ষস্থানীয় সাত নেতা ধরা পড়েন। ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ শায়খ রহমান, বাংলা ভাই ও সানিসহ পাঁচ জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
র‌্যাবের আইন ও জনসংযোগ শাখার পরিচালক কমান্ডার এম সোহায়েল প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে জেএমবির কিছু সদস্য সক্রিয় থাকলেও তাঁদের অবস্থান খুব দুর্বল। পুনরায় সংগঠিত হওয়ার সামর্থ্য তাঁদের নেই।
হামলা সম্পর্কে সানির বিবরণ: গ্রেপ্তারের পর টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদে জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান আতাউর রহমান সানি জেএমবির ভেতর-বাইরের অনেক তথ্য তুলে ধরেছিলেন।
টিএফআই সেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৭ আগস্টের হামলার ব্যাপারে সানি বলেন, ওই বোমা হামলার বিষয়ে প্রথমে বৈঠক হয় ২০০৪ সালের জুলাই মাসে বাসাবোয় সানির ভাড়া করা বাসায়। ওই বৈঠকে জেএমবির ঢাকা জেলার দায়িত্বশীল রবি, গাজীপুরের এনায়েত, নারায়ণগঞ্জের তানভীর ও শামীম, কক্সবাজারের মিজান, নরসিংদীর মোসাহাব, চট্টগ্রামের মোহাম্মদ, টাঙ্গাইলের তাসনীম, মুন্সিগঞ্জের আবদুল্লাহ, খাগড়াছড়ির নাসির ও মানিকগঞ্জের আবুল কাশেম উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সানি সবাইকে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি বোমা হামলার জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। বৈঠকে বোমা ফাটানোর ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর ২০ জুলাই (২০০৪) জেএমবির এহসার সদস্য মিজান ও মনির খিলক্ষেতের একটি আস্তানায় বোমা তৈরির সরঞ্জাম মজুদ করেন। এ ছাড়া শায়খ আবদুর রহমানের জামাতা আবদুল আওয়ালের সংগ্রহ করা ১৫টি পিস্তল ও লেদ মেশিনে গ্রেনেডের আদলে তৈরি বোমার খোল মজুদ করা হয়।
সানির বিবরণ অনুযায়ী, শায়খ রহমানের নির্দেশমতে, জুলাই মাসে বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছ থেকে বোমার সঙ্গে দেওয়ার জন্য তৈরি করা প্রচারপত্র সংগ্রহ করেন। এগুলো ছিল বাংলা, ইংরেজি ও আরবি ভাষায়। প্রচারপত্র আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন জেএমবির আমির শায়খ রহমান নিজে। ওই সময় তিনি বগুড়ায় তাঁর জামাতা আবদুল আওয়ালের বাসায় ছিলেন। তিন ভাষায় ৩০ হাজার কপি প্রচারপত্র ছাপা হয় বাসাবো বৌদ্ধ মন্দিরের পাশের একটি ছাপাখানায়। মির্জাপুরের আকরাম ও জয়পুরের তামিম কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এসব প্রচারপত্র সর্বত্র পাঠানোর কাজ করেন। ২ আগস্ট বোমা বিশেষজ্ঞ মোল্লা ওমরকে বোমা তৈরি করতে বলা হয়। এরপর মোল্লা ওমর সরঞ্জাম সংগ্রহ করেন এবং ১২ ও ১৩ আগস্ট ১৯০টি বোমা তৈরি করেন। কার্টনে ভর্তি বোমাগুলো প্রথমে নেওয়া হয় কুমিল্লায়। সেখান থেকে পাঠানো হতে থাকে দেশের বিভিন্ন স্থানে। সংগঠনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নির্দেশ দেওয়া হয় ১৭ আগস্ট বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে বোমাগুলোর বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে। ওই সময় শায়খ আবদুর রহমান সপরিবারে রাজধানীর মাদারটেকের বাসায় ছিলেন। সানি বলেন, ১৭ আগস্ট বোমা হামলার খবর জানানোর পর শায়খ আবদুর রহমান সবাইকে স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে বলেন।

No comments

Powered by Blogger.