ভিন্নমত-দেশি কম্পানির ব্যালান্সশিট বিশ্বাস করেন! by আবু আহমেদ

আলী রেজা সাহেব ২০১০ সালে অন্যের দেখাদেখি কিছু শেয়ার কিনে এখন ভীষণ মনঃকষ্টে আছেন। শেয়ারবাজারের ফাঁকি-ঝুঁকি সম্বন্ধে যখন বুঝলেন, তখন দুর্ভাগ্য হলো, তাঁর হাতে বিনিয়োগ করার মতো আর কোনো অর্থ নেই। যে অর্থ এর আগে বিনিয়োগ করেছেন, প্রায় ৩০ লাখ টাকা, তা বর্তমান বাজারমূল্যে অর্ধেকে নেমে এসেছে।


ভাগ্য ভালো, রেজা সাহেবের দৈনন্দিন খরচের জন্য ওই অর্থের ওপর নির্ভর করতে হয় না। একটা বর্ধিষ্ণু কম্পানিতে ভালো বেতনে চাকরি করেন। ছেলে দুজন প্রতিষ্ঠিত। তাঁর বয়স ৫৫ থেকে ৬০-এর মধ্যে হবে। এখনো কর্মোদ্যমে বেশ গতিময়। আমাকে পেলেন ফুটপাতে। দেখে বললেন, আমি যদি সময় দিতে পারি, তাহলে পাঁচ মিনিট কথা বলতে চান। পাশেই একটা দোকানে বসে তাঁর সঙ্গে ২০-২৫ মিনিট কথা বললাম। প্রথমেই বললাম, কারো কথা ধরে শেয়ার কিনবেন না। কথা শুনতে আপত্তি নেই। তবে সেই কথার ওজন আছে কি না যাচাই করবেন নিজ জ্ঞানে। দুই. যে কম্পানির শেয়ার কিনছেন ওই কম্পানির ব্যবসা সম্বন্ধে আপনাকে সম্যক অবহিত হতে হবে। তিন. অনেক সময় কম্পানি ভালো ব্যবসা করে; কিন্তু আয় হিসাবে দেখায় না। এতে কম্পানির উদ্যোক্তারা লাভবান হলেও আপনি হবেন না। তাদের থেকে সাবধান। এতটুকু শোনার পর রেজা সাহেব বললেন, তিনি যেসব শেয়ার কিনেছিলেন এগুলোর শেয়ারপ্রতি আয় বা EPS তো ভালোই ছিল। অবশ্য এখন ২০১২ সালে জুলাইয়ে যে EPS দিল তাতে ধস নেমেছে। আমি বললাম, রেজা সাহেব, এখানেই তো আপনি এবং অন্যরা ভুল করছেন। ২০০৯ ও ২০১০ এই দুই বছরে অনেক কম্পানি ভালো EPS দেখিয়ে দিল, কারণ ওইগুলো দেখালে উদ্যোক্তাদের শেয়ার বেচতে সুবিধা হয়েছিল। এখন সেই অংশ শেষ। সুতরাং এখন তাদের লাভে, তথা EPS-এ ভাটা পড়েছে। এর সব আমি রেজা সাহেবকে বললাম। বেশির ভাগ দেশীয় কম্পানির উপস্থাপিত স্থিতিপত্র বিশ্বাসযোগ্য নয়। এদিক দিয়ে বিদেশি কম্পানির স্থিতিপত্র অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। দেখুন, আপনি বিনিয়োগ করে ৫০ শতাংশ হারিয়েছেন; কিন্তু যাঁরা ঋণ করে বিনিয়োগ করেছেন তাঁরা ৭০ শতাংশ হারিয়েছেন। কিন্তু যাঁরা বিদেশি কম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করেছেন তাঁরা হারিয়েছেন মাত্র ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। সেই হারানোও আগামী দুই বছরে পুষিয়ে ফেলতে পারবে। কেন কম হারাল? কারণ তাদের EPS বিশ্বাসযোগ্য ছিল, আর দেশীয় কম্পানির EPS বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। একটা মস্তবড় জুয়ার আসর আমাদের শেয়ারবাজারকে ঘিরে ফেলেছিল, আর এর ভিকটিম হলেন আপনারা। মানে অন্য ৩০ লাখ বিনিয়োগকারী। আপনি যদি মনে করেন, দেশি কম্পানি মিথ্যা কথা বলছে না, তাহলে নিম্নের কয়েকটি বিষয়ে অনুধাবন করার জন্য অনুরোধ করব।
১. প্রিমিয়ামসহ ১৫০ টাকায় IPO বেচতে চেয়ে পরে শুধু ৭৫ টাকায় কিভাবে IPO বেচতে রাজি হলো?
২. প্রিমিয়ামসহ Right Offer দিয়ে উদ্যোক্তারা নিজ অংশের Right Share-গুলো নিল না কেন? নিশ্চয়ই তারা জানত তাদের শেয়ারের মূল্য অত না। রেগুলেটর SEC নির্বোধ বলে এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা এমন ব্যবহার করতে সাহস পেয়েছে। আর সেই Right ইস্যুকে অবলোকন তথা Underwrites-রা নিল না কেন? এ ক্ষেত্রে তাদের কী শাস্তি হয়েছে বলতে পারেন? এ পর্যন্ত শুনে রেজা সাহেব বললেন, তাহলে সবই বোগাস এবং ফাঁকিবাজি। আমি বললাম, অনেকটা তা-ই। আমারও সময় শেষ, রেজা সাহেব থেকে বিদায় নিলাম। মনে মনে ভাবলাম, রেজা সাহেব তো শিক্ষিত লোক। আর যাঁরা কম শিক্ষা নিয়ে শেয়ারবাজারে প্রবেশ করেছেন তাঁরা কি কম্পানির ব্যালান্সশিট, তথা স্থিতিপত্র পড়তে পারেন? তাঁরা কি কম্পানির ছলচাতুরীগুলো ধরতে পারেন? তাঁরা কি জানেন রেগুলেটর SEC-তে অজ্ঞতায় ভর্তি? তারা জানে না বলেই ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে এত বড় লুটতরাজ সংঘটিত হতে পারল। ২০০৯ ও ২০১০ সালে সবাই খুশি ছিল। আর যখন লুণ্ঠনযজ্ঞটা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, তখন বলাবলি শুরু হলো কেন এমন হলো, কী করে হলো, কারা করল? আজকে শেয়ারবাজার অনেকটা মৃত। প্রায় সব বিনিয়োগকারীই বাজার ত্যাগ করেছেন। SEC-র ভুলের কারণে প্রাইমারি তথা IPO বাজারটাও অনেকটা বন্ধ। সত্য হলো, যেসব শেয়ারকে আজও IPO হিসেবে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে ওইগুলোর বেশির ভাগই দুই-তিন বছরের মধ্যে Z গ্রুপে তালিকাভুক্ত হলেও আশ্চর্য হব না। এসব কম্পানির উদ্দেশ্যই হলো যা পাওয়া যায়। কারণ তারা তো জানে তাদের শেয়ারের এই মূল্যও নেই।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.