বাঘা তেঁতুল- তালা-চাবি by সৈয়দ আবুল মকসুদ

ঢাকা থেকে বাস বা ট্রেনে ঝুলে সন্ধ্যার আগে গ্রামে পৌঁছায় রুবেল। রুবেল নতুন জামাই। মাস পাঁচেক আগে বিয়ে করেছে। বারান্দায় বোঁচকা নামিয়ে ঘাম মোছে রুবেল। রান্নাঘর থেকে শাশুড়ি বেরিয়ে এসে বলেন, ‘ভালো আছ বাবা? দোকানে কারে রাইখা আসলা?’ রুবেল বলে, ‘চিন্তা নাই আম্মা। নিজ দায়িত্বে তালা দিয়া আইছি।’


রুবেলের বউ পারুলের চোখ ব্যাগের দিকে। ব্যাগগুলো জিনিসে ঠাসা। না খুলেই ব্যাগের ভেতরে কী আছে তা অনুমান করে পারুল। মায়ের জন্য আছে শাড়ি। তার জন্য আছে শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট। কসমেটিকস, সালোয়ার-কামিজ আছে দুই সেট। আরও দু-একটা আইটেম আনার কথা। বোকা বোকা পুরুষ। ঠিক সাইজমতো আনতে পারছে কি না, সন্দেহ পারুলের।
সকাল সাড়ে সাতটা। রুবেল-পারুল গভীর ঘুমে। পারুলের গলার ওপরে হাত রুবেলের। বালিশের ওপাশে মাথার কাছে মোবাইল ফোন। মোবাইলে রোম্যান্টিক গানের সুর বেজে ওঠে। চরম বিরক্তি নিয়ে ফোন ধরে রুবেল: হ্যালো, কে? ঝন্টু ভাই? কী খবর, এত সকালে? কী কন!...
তড়াক করে বিছানা থেকে লাফিয়ে ওঠে রুবেল, বেহাল কাপড় ঠিক করতে করতে বিছানায় উঠে বসে পারুল। সে কিছু বুঝতে পারে না। অপূর্ণ ঘুম তার দুই চোখে। বলে, ‘হইছে কী? কেউ মারা গেছে?’
বেসামাল রুবেল বলে, ‘কী আর হইব? আমারে মাইরা সব নিয়া গেছে। দোকান সাফ। টেবিল আর টুল ছাড়া দোকানে কিছুই নাই।’
আগের দিনের রান্না করা হাঁসের মাংসের ভুনা তরকারি ছিল। জামাইয়ের নাশতার জন্য শাশুড়ি আম্মা চিতই পিঠা বানাচ্ছিলেন। চুলার পাড় থেকে তিনি দৌড়ে এলেন উঠানে। পিঠার খোলা পুড়তে লাগল। তিনি বিলাপ করতে লাগলেন।
পাশের ভূঁইয়াবাড়ির তিনবার এসএসসি ফেল বেকার যুবক কোব্বাতের অনেক দিন পারুলের দিকে চোখ ছিল। কিছু চিরকুটও আদান-প্রদান হয়েছে। রোজগার নেই বলে পারুল তাকে পাত্তা দেয়নি। সে দাঁত ব্রাশ করছিল কলপাড়ে দাঁড়িয়ে। দ্রুত ছুটে এল সান্ত্বনা দিতে। তার চোখে-মুখে পৈশাচিক উজ্জ্বলতা। রুবেলকে উদ্দেশ করে বলল, ‘নিজ দায়িত্বে দুলামিয়া তালা দিয়া আসেন নাই?’
জ্বলে ওঠে পারুল। ঝামটা দিয়ে বলে, ‘কবু ভাই, আপনে দাঁত মাজেন গিয়া।’
এবার নিজ দায়িত্বে ঘরে তালা দিয়ে বহু লোক রুবেলের মতোই ঈদ করবে।
সুদূর অতীতে যিনি তালা-চাবি আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি কল্পনাও করতে পারেননি যে বাংলার মাটিতে একদিন তালা হয়ে উঠবে একটি গুরুতর আলোচ্য বিষয়। তালা পাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
মানুষ তালা ব্যবহার করছে হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকে। কিন্তু বস্তু হিসেবে তালা গত সপ্তাহ পর্যন্ত ছিল অনালোচিত। গত কয়েক দিনে তালার চাহিদা যে হারে বেড়েছে, তাতে তালা ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট গড়ে উঠল বলে! ঈদ ও দুর্গাপূজার আগে ভোজ্যতেলের মতো মানুষকে ডবল দামে তালা কিনতে হবে। আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বহু তালা ব্যবসায়ী বিলিয়নিয়ার হয়ে যাবেন। এবং তখন তাঁরা নির্বাচন করবেন।
আইনশৃঙ্খলা-সর্বাধিকারী তালাবিষয়ক যে উপদেশ দিয়েছেন, আইন প্রতিমন্ত্রী তার মর্মবাণী খোলাসা করে দিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, মানুষকে ‘সচেতন’ করার জন্যই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাসাবাড়িতে ও দোকানপাটে তালা ঝোলাতে বলেছিলেন। যদি কেউ তাড়াহুড়ায় ভুলে তালা না লাগিয়ে বাড়ি যায়!
আমাদের রাষ্ট্রের অধিপতিরা তালাবিষয়ক উপদেশ দেওয়ার সময় একটি কথা ভুলে গেছেন। যেদিন তালা আবিষ্কার করা হয়, তার পরের সপ্তাহেই তালা ভাঙার বিদ্যাও কেউ অর্জন করে। তাই তালা মানুষের নিরাপত্তার শেষ আশ্রয় নয়।
চুরি করা চোরের ফান্ডামেন্টাল রাইট। ডাকাতি করার অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করার অধিকার আমাদের নেই। উপদেশ বা নির্দেশ দিয়ে যদি তাদের চুরি-ডাকাতি করা থেকে বিরত করা যেত, তাহলে ঈদের আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দিলেই হতো: অত তারিখ থেকে অত তারিখ পর্যন্ত ১২০ ঘণ্টা কোনো চুরি-ডাকাতি করবেন না। ওই নির্দেশ মেনে চোর-ডাকাত টানা ঘুম দিত। তখন নিজ দায়িত্বে তালা লাগিয়েও ঈদে বাড়ি যাওয়ার প্রয়োজন হতো না।
চুরি-ডাকাতি করে কেউ যাতে পার পেতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সরকারের কাজ চোরকে আটক করা। আদালতে বিচার করা। শাস্তি দেওয়া। কোনো উপদেশে নয়, সাজার ভয়েই চোর চুরি করার আগে দশবার ভাববে।
দেশে দেশে যাঁরা বড় বড় পদে আসীন, তাঁরা জানেন রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছিল সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব নাগরিকের স্বার্থ রক্ষা ও নিরাপত্তা দেওয়ার একটি নিরপেক্ষ সংস্থা হলো রাষ্ট্র। যে সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট বা সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের জন্ম, তার দায়িত্ব অনেক বড়। রাষ্ট্র অর্থাৎ সরকারকে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে হয়।
আজ বাংলার মানুষের পাশে রাষ্ট্র নেই। তাকে তাই চলার পরামর্শ নিজ দায়িত্বে। তার ভরসা তালা। তালা জয়যুক্ত হোক। জয় তালা-চাবি।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.