অন্য রকম প্রতিবাদ ও ঈদ আনন্দ by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

এ এক অন্য রকম প্রতিবাদ। কর্দমাক্ত রাস্তায় ধানের বীজ রোপণ করে পাশে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে খারাপ রাস্তার প্রতিবাদ করা। রাস্তা তো নয় যেন জমি, যেখানে ধান রোপণ করা যায়। প্রতিবাদটি চট্টগ্রামের মৌলভী পুকুরপাড়ার এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে করা।


কালের কণ্ঠ ৪ আগস্ট ছবিসহ তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সংবলিত প্রতিবাদটি প্রকাশ করেছে। এ ধরনের ভিন্নধর্মী প্রতিবাদ এর আগে আমাদের চোখে পড়েনি। একটু পেছনের দিকে তাকাই। গত বছরের ঈদের কথা। রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থার জন্য নাড়ির টানে গ্রামে ঈদ করতে যাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিল। রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা আর তার ওপর একটানা বৃষ্টি পরিস্থিতিকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। তাৎক্ষণিকভাবে সড়ক মেরামতের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও বৃষ্টি ও অন্যান্য কারণে উদ্যোগ সফল হয়নি। বাস্তবতা ও প্রতিবাদস্বরূপ ঢাকায় বসবাসরত কেউ কেউ গ্রামে ঈদ করতে যায়নি। ঈদের দিন ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ঈদ উদ্যাপন করার ঘোষণা দেয়। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও সরকারকে আলটিমেটামসহ হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তাদের আন্দোলন থেমে যায়। আরেকটি ঈদ আসন্ন।
তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রীর এক বক্তব্য আমাদের মনে আশা জাগাতে পারেনি। তাঁর বক্তব্য ছিল, যোগাযোগ খাতে বড় বড় প্রকল্পের জন্য ছোট ছোট প্রকল্পের দিকে গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব হয়নি। আমরা ছোট প্রকল্পে গুরুত্ব দিইনি; কিন্তু বড় প্রকল্পগুলোর অবস্থা আজ ভালো নয়। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে তাদের ঋণদান প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ঢাকা শহরের যোগাযোগের জন্য অন্যান্য প্রকল্পের অগ্রগতিও সন্তোষজনক নয়। দু-একটি প্রকল্প এখন পর্যন্ত শুরুই হয়নি। আমাদের ভালো লাগত যদি সব কিছুর বিনিময়ে হলেও পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ শুরু হতো। কিন্তু এ প্রকল্প নিয়ে যে মেঘ জমেছে, তা অচিরে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে কি না সন্দেহ। প্রথমে দপ্তর বদল এবং পরে মন্ত্রিত্ব থেকে সরানোর পন্থা, পদ্মা সেতু প্রকল্প আলোর মুখ দেখাবে- কর্তাব্যক্তিদের এমন মতামত আমাদের হতাশার মধ্যে আলোর ঝিলিক দেখাচ্ছে। তাঁদের কথা যেন সত্য হয়, আমরা এমনটিই চাই। আমরা চাই সব কিছুর বিনিময়ে পদ্মা সেতু।
গত এক বছরে রাস্তাঘাটের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। বিভিন্ন রাস্তার কাজ চলছে; কিন্তু কাজের গতি মন্থর। কোথাও কোথাও কাজের নামে হরিলুটও চলছে। যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী সরাসরি অনেক কাজের মনিটর করছেন এবং কাজের গতি সশরীরে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন। কিন্তু ঢাকায় বসবাসরত মানুষের মনে শঙ্কা রয়েছে যে তারা নির্বিঘ্নে এবার ঈদ করতে গ্রামের বাড়ি যেতে পারবে কি না? শুধু রাস্তাঘাট ভালোই একমাত্র পথ নয়। বাস, লঞ্চ ও ট্রেনের টিকিট পাওয়াও জরুরি। হেঁটে তো আর গ্রামের বাড়ি যাওয়া যাবে না। প্রতিবছর রমজান এলে দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতির জাঁতাকলে বিক্রেতারা মানুষকে পিষতে থাকে। এবারের রমজানে এমনটি বেশি লক্ষ করা যায়নি। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের প্রবাহ বেশি থাকায় এমনটি হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। সবজির মৌসুম শেষ না হওয়া এবং ব্যাপক বন্যা না হওয়ায় রমজানে সাধারণ মানুষ সবজির বাজারে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাচ্ছে এবং বাকি সময়ও হয়তো পাবে। যদিও মাছ এখনো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে, তবুও সরকার কর্তৃক মাছ রপ্তানি বন্ধ করার বিধির ফলে মাছের দাম কিছুটা হলেও কমে আসছে। পবিত্র এ মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেখানে জিনিসপত্রের ওপর ছাড় দেওয়া হয়, সেখানে একমাত্র বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। এখানে রমজানের সময় মানুষের ওপর একধরনের দমন-পীড়ন চলে। এ ধারা অব্যাহত থাকে ঈদের পর ঘরমুখো মানুষের নিজ গন্তব্যে আবার ফিরে আসা পর্যন্ত। জনগণের দুর্ভোগের কারণ হিসেবে যারা থাকে, তাদের যুক্তি আমাদের কাছে হাস্যকর ও খোঁড়া বলে মনে হয়।
ঈদের প্রাক্কালে প্রতিবছর বাস ও লঞ্চের টিকিটের দাম বাড়ানো হয়। এর ওপর রয়েছে টিকিটের কালোবাজারি। ট্রেনের টিকিট পাওয়ার জন্য সারা রাত রেলস্টেশনে পর্যন্ত থাকতে হয়! এর পরও কাঙ্ক্ষিত টিকিট পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। টিকিট পাওয়া অনেকটা সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এ ধরনের অব্যবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি মিলছে না। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ঈদ সামনে রেখে নৌযান ও বাস মালিক সমিতির সঙ্গে দফায় দফায় মিটিং করেন। মালিকপক্ষ বাস ও লঞ্চের ভাড়া না বাড়ানোর অঙ্গীকার করে। কিন্তু এ ধরনের মিটিং কার্যত কোনো ফল দেয় না। বাস মালিক বা লঞ্চ মালিকরা ঠিকই ঈদের সময় টিকিটের দাম বাড়িয়ে দেন। তাঁদের যুক্তি হলো, 'অন্যান্য সময় আমরা ভাড়া কম নেই। একমাত্র ঈদের সময় আমরা যাত্রীদের কাছ থেকে সঠিক ভাড়া নেই।' কেন তাঁরা সব সময় কম ভাড়া নেন? এ প্রশ্নের উত্তর তাঁদের কাছে পাওয়া দুরূহ। তাঁদের এ ধরনের খোঁড়া ও মনগড়া যুক্তি এমনকি বিকারগ্রস্ত মানুষকেও বিশ্বাস করানো কষ্টকর। তাঁরা এ ধরনের যুক্তি দিয়ে মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর সাধারণ মানুষ অসহায়ের মতো তাঁদের কথায় কাজ করছে। কেননা বিকল্প ভাবনার কোনো সুযোগ নেই। একদিকে টিকিটের মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে টিকিট কালোবাজারি। বাস ও লঞ্চ মালিক সমিতি কর্তৃক নির্ধারিত মূল্য ছাড়া কালোবাজারে আরো বেশি দামে টিকিট কেনার বিড়ম্বনা। এ যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। এরপর রয়েছে রাস্তাঘাটের বেহালদশা। ঠিক সময়ে বাড়িতে পেঁৗছা যাবে কি না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। দুই দশক ধরে এ অবস্থার কোনো উন্নতি আমরা দেখছি না। আমরা জানি না, আগামী বছরগুলোতেও আমাদের একই অবস্থা যাবে কি না। যত দিন আমরা মানুষকে শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা কমাতে না পারব, তত দিন আমাদের এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা কষ্টসাধ্য হবে। তার পরও সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে পারলে কিছুটা উন্নতি হতে পারে।
শুরুটা করেছিলাম রাস্তায় ধানের বীজ রোপণের মাধ্যমে রাস্তাঘাটের বেহালদশার প্রতিবাদ করার মধ্য দিয়ে। শেষ করছি ঈদে ঘরমুখো মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যে গমন ও ফিরে আসা কামনা করে। শুধু ঈদ উপলক্ষে নয়, সব সময়ের জন্য আমাদের রাস্তাঘাট ভালো থাকা দরকার, সব সময়ের জন্য দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকা প্রয়োজন, সব সময়ে বাস ও লঞ্চের ভাড়া একই রকম হওয়া প্রয়োজন। মানুষের আনন্দকে পুঁজি করে, মানুষকে আর্থিক কষ্ট দেওয়া কারো নীতি হতে পারে না। যাঁরা রমজানকে পুঁজি করে প্রতিবছর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করেন, ঈদ সামনে রেখে বাস ও লঞ্চের ভাড়া বাড়ান, আমরা তাঁদের মধ্যে সুন্দর বোধোদয় আশা করি। তাঁরা যেন এ ধরনের অন্যায় কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখেন। সাধারণ মানুষকে স্বাচ্ছন্দ্যে ঈদ উদ্যাপন করার সুযোগ তৈরি করে দেন- এ আশা আমাদের সবার।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান
ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.