চালচিত্র-হাসিনা সরকারকে কি স্পেনের গণতান্ত্রিক সরকারের ভাগ্যবরণ করতে হবে! by শুভ রহমান

সরকারের অনুমোদন নিয়েই প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ১২ মার্চ মহাসমাবেশ করতে যাচ্ছে। সুতরাং সরকার গণতন্ত্র কেড়ে না নিলে এ মহাসমাবেশ করার প্রয়োজন হতো না, এমন যুক্তি সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। মানুষ বলছে, এভাবে শক্তির মহড়া দেওয়ারই বরং কোনো প্রয়োজন ছিল না।


এই মহড়া দিতে গিয়ে যদি নাশকতার শক্তি, জঙ্গিবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পায়, জনগণের জানমালের ক্ষতি করে, দেশের সম্পদ ধ্বংস করে, তার পুরো দায়টা তো বিএনপির ওপরই বর্তাবে। বিএনপির রাজনৈতিক অস্তিত্বেই টান পড়বে। মানুষ তো স্বাভাবিকভাবেই ভাবছে, এসবের কোনো দরকার ছিল না। বিএনপি সংসদীয় নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি মেনে সংসদে গিয়েই তাদের সব দাবি জানাতে পারত, অন্তর্বর্তী সরকারের যে ফর্মুলা তারা দলীয় উদ্যোগে প্রণয়ন করছে বলে ইতিমধ্যে পত্রপত্রিকার মাধ্যমে দেশবাসী জানতে পেরেছে, সেই ফর্মুলা নিয়েই সরকারি দলের সঙ্গে সংসদের অধিবেশনেই আলোচনা করে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাধারণ মানুষের ভাবনাচিন্তার প্রতি, সুস্থ ও সংসদীয় ধারার রাজনীতির প্রতি বিএনপি এখন পর্যন্ত কর্ণপাত করছে না।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকারি দল কেন সংঘাতের ঝুঁকি সৃষ্টি করে একই দিনে না হোক ১২ মার্চ ঘিরেই র‌্যালি, মানববন্ধন, সবের কর্মসূচি দিচ্ছে। ওয়াকওভার দিলেই তো পায়ত, তাহলেই তো আর সংঘর্ষ বাধার ঝুঁকি থাকত না। আসলেই কি তা-ই, সত্যিই কি ঝুঁকি থাকত না! সরকারের গোয়েন্দা রিপোর্ট তো অন্য কথা বলছে। তারা বলছে, এর আগে ১৮ ডিসেম্বর যেমন বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনার নামে নাশকতার চেষ্টা করা হয়েছিল, এবারও তেমনি নাশকতা, জ্বালাও-পোড়াও ও ভাঙচুরের আশঙ্কা রয়েছে। এ রকম ক্ষেত্রে একটি নির্বাচিত ও প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকার কিভাবে জনগণের জানমাল ও দেশের সম্পদ রক্ষার পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না করে চুপ করে বসে থাকতে পারে? পৃথিবীর কোথাও কোনো গণতান্ত্রিক সরকারই দেশ ও জনগণের প্রতি সে দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করতে পারে না। সরকার তাই যত রকমভাবে পারে, নিজস্ব শক্তি দিয়ে, তার ১৪ দলীয় জোটের শক্তি দিয়ে, তার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রস্তুত রেখে দেশ ও জনগণের সুরক্ষায় সাধ্যমতো কর্মসূচি নিয়েছে। এর ভেতরে মানুষ দায়িত্ব সচেতনতা ছাড়া অন্যকিছু দেখতে পাচ্ছে না। সরকারের এই দায়িত্ব সচেতনতার কারণে যদি অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘাত-সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়, তার দায়দায়িত্ব তো বিরোধী হঠকারী রাজনীতির ওপরই বর্তাবে। দেশের সাধারণ মানুষ স্বভাবতই এতে যারপরনাই শঙ্কা ও অস্বস্তিতে রয়েছে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর দেশের মানুষ এমন একটা যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে পড়বে, তাদের অবস্থা উলুখড়ের মতো অসহায় হয়ে দাঁড়াবে, এটা কেউ কল্পনাও করেনি।
স্বাধীনতার এই অগি্নঝরা মার্চ মাসে সাধারণ মানুষ ছিল নেতৃত্বের অবস্থানে। একাত্তরের পয়লা মার্চ তারাই রাজপথে নেমে গণবিদ্রোহে ফুঁসে উঠেছিল। তাদের স্বাধীনতার চেতনার বিস্ফোরণকেই ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সংহত রূপ দিয়েছিলেন এবং মাসব্যাপী অসহযোগের ডাক দিয়েছিলেন। তার পরের ইতিহাস সবার জানা। দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধে বাঙালি হানাদার পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার রক্তসূর্য। স্বাধীনতার জন্য সাধারণ মানুষের ত্যাগতিতিক্ষা, চূড়ান্ত আত্মত্যাগ ও দুঃসহ দুঃখকষ্ট ভোগের কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। মানুষ সেসব ভোলেনি। স্বাধীনতা তাদের কাছেই সবচেয়ে প্রিয়। স্বাধীনতার মর্যাদা তারাই সবচেয়ে বিশ্বস্ততার সঙ্গে রাখবে। কিন্তু তারাই আজ সবচেয়ে অসহায় ও বিপন্ন ৭বোধ করছে স্বাধীনতার চলি্লশ বছর পর। রাজনীতির নামে, স্বাধীনতা রক্ষার নামে, গণতন্ত্র উদ্ধারের নামে তারা কোনো রকম হানাহানি, সংঘাত-সংঘর্ষ কোনোক্রমেই সমর্থন করতে পারে না। বিএনপি বলছে, তারা শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ করবে, কিন্তু যাদের ওঠাবসা, নির্ভরতা যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক মৌলবাদীদের সঙ্গে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ চলার সময় সেই মৌলবাদী জঙ্গিরা এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে না, তার ভরসা কোথায়। এসব হলো যুক্তির কথা। দায়দায়িত্বের কথা। ক্ষমতার বাসনা যখন উদগ্র হয়ে ওঠে, কোনো নিয়মকানুন, সাংবিধানিক রীতিনীতি মানতে চায় না, একটি নির্বাচিত ও প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকারকে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে মরিয়া হয়ে ওঠে, তখন তো কোনো যুক্তি ও কোনো দায়িত্বশীলতার হিতোপদেশ কানে না যাওয়ারই কথা নয়। অবস্থাটা এখন সেখানেই এসে ঠেকেছে। বিরোধী রাজনীতির ধারক-বাহকরা কিছুতেই দেশের সুশীল সমাজ, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক মহল, বন্ধুদেশগুলোর কূটনীতিকবৃন্দ_কারো কথাই কানে না নিয়ে সংসদ এড়িয়ে রাজপথেই 'যুদ্ধ' করে ক্ষমতা দখল করতে চাইছে।
অবস্থাটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে স্পেনের গৃহযুদ্ধের অবস্থার মতো হয়ে দাঁড়াচ্ছে। হিটলার-মুসোলিনি সমর্থিত জেনারেলিসিমো ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিস্টচক্র ট্যাংক-কামান, বিমান হামলা চালিয়ে গণতান্ত্রিক পপুলার ফ্রন্ট গভর্নমেন্টকে উৎখাত করেছিল, রক্তগঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছিল গোটা দেশকে। ভাসিয়ে দিয়ে স্পেনে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল, আজ এখানে যেন নির্বাচিত একটি গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে সে রকম হুমকিই সৃষ্টি করা হচ্ছে। সে সময় আন্তর্জাতিক লেখক ব্রিগেড মরণপণ সম্মুখযুদ্ধ চালিয়ে চরম আত্মাহুতি দিয়েও গণতান্ত্রিক সরকারকে রক্ষা করতে পারেনি। ক্রিস্টোফার কডওয়েল, র‌্যালফ ফঙ্ প্রমুখ বিশ্ববিশ্রুত লেখক ছিলেন সে ব্রিগেডে। উপমহাদেশের জওহরলাল নেহরু, ফিরোজ গান্ধীও যোগ দেন সেই ব্রিগেডে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের 'ফর হুম দ্য বেল টোল্স' নামের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাভিত্তিক বিশ্ববিখ্যাত ও চলচ্চিত্রায়িত উপন্যাস সে-ইতিহাস ধারণ করে রেখেছে। সারা দুনিয়ার বিবেকবান মানুষ গণতান্ত্রিক ও মানবতাবাদী শক্তি সেদিন স্পেনের গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। সত্তরের দশকে চিলিতে সামরিক একনায়ক পিনোশে একইভাবে বিশ্ববিবেককে পদদলিত করে বহিঃশক্তির সহায়তায় ট্যাংক-কামান নিয়ে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে হামলা চালিয়ে নির্বাচিত আয়েন্দে সরকারকে উৎখাত করে এবং তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। আজ এখানে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকারকেও একইভাবে উৎখাতের চেষ্টা হচ্ছে কি না তা দেখতে হবে। দেখতে হবে, ফ্যাসিবাদ আজ আবার এখানে নতুন রূপে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে কি না। এখানে '৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বহিঃশক্তির মদদ নিয়েই ফ্যাসিস্টচক্র স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পরিবারের প্রায় সব সদস্যসুদ্ধ নির্মমভাবে হত্যা করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঊষালগ্নেই স্বাধীনতাকে হত্যার চেষ্টা চালায়। শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার ভুলভ্রান্তি, সাফল্য-ব্যর্থার মধ্য দিয়ে প্রাণান্তকর চেষ্টায় জনগণের পাশে থেকে দেশ পরিচালনা করে আসছে এবং তিন বছর মেয়াদ পূর্ণ করেছে। তাকে আজ নানা অপবাদ দিয়ে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ন্যায়নীতি ও সংসদীয় রীতিনীতি লঙ্ঘন করে ক্ষমতাচ্যুত করার সর্বাত্মক তোড়জোড়কে দেশ ও বিদেশের কোথাও কোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষই সমর্থন করতে পারে না। বিরোধী রাজনীতির নামে অসুস্থ, কাণ্ডজ্ঞানহীন, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য যেকোনো পন্থায় ক্ষমতা গ্রহণে উন্মত্ত কার্যক্রমের শুধু নিন্দাই জানাবে বিশ্ববাসী।
আমরা মনে করি, বিরোধীদের এখনো সম্বিৎ ফেরার, সুস্থ রাজনীতিতে এবং সংসদে ফেরার সময় রয়েছে। গণতন্ত্রকে, যেকোনো মূল্যে, স্বাধীনতাকে সচেতনভাবে সর্বশক্তি দিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে রক্ষার সময় রয়েছে। কোনো রকম কালক্ষেপণ না করে অবিলম্বে সংসদে ফেরা এবং নির্বাচন পরিচালনার গ্রহণযোগ্য একটি ফর্মুলার ব্যাপারে সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে বিরোধী দলের দেশ ও জনগণের স্বার্থে সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত। নিজেদের সংসদীয় গণতান্ত্রিক সত্তা হিসেবে, সর্বজনগ্রাহ্য রাজনৈতিক ও জনকল্যাণকর শক্তি হিসেবে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বিরোধী দল এই ক্রান্তিলগ্নে সবচেয়ে সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নেবে এবং ইতিহাসের যৌক্তিক পথ থেকে বিচ্যুত হবে না। এটাই সচেতন দেশবাসীর ঐকান্তিক প্রত্যাশা।

০৪.০৩-২০১২

No comments

Powered by Blogger.