মাগুর মাস by শেখ রোকন

যুক্তরাষ্ট্রে চলছে 'ন্যাশনাল ক্যাটফিশ মান্থ'। এক সময় যদিও কেবল প্রাকৃতিক জলাধারে মিলত, কয়েক দশক আগে থেকে খামারেও চাষাবাদ হচ্ছে মাছটি। মিসিসিপি, আলাবামা, আরকানসাস ও লুইসিয়ানার মতো রাজ্য এই মাছ উৎপাদনে প্রসিদ্ধ।


ক্যাটফিশ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পুষ্টির বড় অংশের জোগানদাতাই কেবল নয়; অনেক গ্রামীণ জনপদে রাজস্ব ও কর্মসংস্থানেরও গুরুত্বপূর্ণ ভরসা। অনেকে শখ করে পারিবারিক পুকুরেও ক্যাটফিশ পালন করেন।
বন্য একটি মাছকে জাতীয় খাদ্যাভাস, পুষ্টি ও অর্থনীতির অনিবার্য অনুষঙ্গ করে তোলার কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে প্রথম প্রজন্মের ক্যাটফিশ খামারিদের। দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের চাষি, প্রক্রিয়াজাতকারী ও পরিবেশকরা মাছটির স্বাদ ও সুনাম বৃদ্ধিতে রেখেছে আরও উদ্ভাবনী ক্ষমতার ছাপ। তাদের সবার অবদানের স্বীকৃতি দিতেই আশির দশকে আগস্টকে ক্যাটফিশ মাস ঘোষণা করা হয়। মাসজুড়েই যুক্তরাষ্ট্রে চলে নানা আয়োজন_ মূল্য ছাড়, নতুন রেসিপি ঘোষণা কিংবা ক্যাটফিশ কিনলে সংশ্লিষ্ট কিছু উপকরণ ফ্রি ইত্যাদি।
ক্যাটফিশ কেবল যুক্তরাষ্ট্রে নয়, দুনিয়াব্যাপী ছড়ানো। বস্তুত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সুলভ নানা ধরনের মাছের বৈশ্বিক ডাক নাম এটি। দেখতে ও আকারে যেমনই হোক, যদি বিড়ালের মতো গোঁফ থাকে, ইংরেজিতে সেটাকেই 'ক্যাটফিশ' বলা হয়। বাংলাদেশে এ প্রজাতির মধ্যে রয়েছে টেংরা, আইড়, পাঙ্গাশ, পাবদা, বোয়াল। তবে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে শিং, বিশেষ করে মাগুর_ বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ায় সুলভ এই মাছ সরাসরি ক্যাটফিশ প্রজাতির। প্রতিকূল পরিবেশে শুকনো মাটিতেও পাখনা দিয়ে চলাফেলা করতে পারে বলে মাগুর মাছের ইংরেজি নাম ওয়াকিং ক্যাটফিশ।
দুই-তিন দশক আগেও যারা গ্রামীণ জনপদে বেড়ে উঠেছেন স্বল্প বৃষ্টিতে এক জলাশয় থেকে অন্য জলাশয়ে মাগুর মাছের চলাফেলার দৃশ্য নিশ্চয়ই তাদের চোখে পড়েছে। ঘরের ভেতর হাঁড়িতে জিইয়ে রাখা মাগুর মাছ লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ে চম্পট দেওয়ার ঘটনাও রয়েছে। স্বাদু ও শক্ত প্রাণের ওই মাছ জিইয়ে রাখা হতো উপলক্ষের জন্যও। জামাই বেড়াতে এলে পাতে মাগুর মাছের ঝোল দিতেই হবে। রোগীর পথ্য হিসেবেও মোক্ষ।
এখন অবশ্য সে রাম নেই, অযোধ্যাও নেই। দেশীয় প্রজাতির মাগুর এখন বিরল প্রজাতি। তার বদলে দেশ ছেয়ে গেছে 'আফ্রিকান' বলে পরিচিত বিদেশি প্রজাতির মাগুরে। কালো ও হোঁতকা চেহারার বলেই হয়তো এমন নাম। আদতে এটি 'নর্থ আমেরিকান ক্যাটফিশ' এবং বাংলাদেশে এসেছিল থাইল্যান্ড থেকে। প্রাথমিকভাবে মৎস্য অধিদফতরের সংরক্ষিত বিভিন্ন পুকুরে স্থান পেলেও '৮৮ সালের দেশ ডুবানো বন্যায় ছড়িয়ে পড়ে। এখন চাষাবাদ হয় নোংরা ডোবা ও পুকুরে। ঢাকার উপকণ্ঠের লেগুনাগুলোতেও এক সময় ব্যাপক চাষাবাদ হতো। ২০০৪ সালে রাজধানীর সুয়ারেজ লাইন থেকে ২০ কেজি ওজনের কয়েকটি মাগুর মাছ ধরা পড়ার ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। এই মাছের প্রধান বৈশিষ্ট্য রাক্ষুসে ক্ষুধা। ভয়ানক মাংসাশী। পুকুরে সাঁতার কাটতে গিয়ে আফ্রিকান মাগুরের কবলে পড়ে হাঁসের মৃত্যুর ঘটনাও আকসার ঘটেছে। ২০০৩ সালে ময়মনসিংহে জনৈক চাষির তিন বছরের সন্তান মাগুরের আক্রমণে নিহত হওয়ার অঘটনও আতঙ্ক জাগানিয়া সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল। এ ছাড়া জলাশয়ে এই মাছের কারণে প্রতিবেশ বিনষ্টের অভিযোগও তুলছেন কেউ কেউ।
দেশীয় মাগুর যতটা আদৃত ছিল, বিজাতীয় এই ক্যাটফিশ যেন ততটাই অপাঙ্ক্তেয়। এর স্বভাব ও লালন প্রক্রিয়ার কারণে বেশিরভাগ নাগরিকই মাছটি খেতে চান না। নতুন প্রজন্মের কারও কাছে যদি জাতীয়-বিজাতীয় নির্বিশেষ সব মাগুর মাছই অখাদ্য বিবেচিত হয়, তাহলে দোষ দেওয়া যাবে না। কিন্তু আফ্রিকান মাগুরের চাষ থামানো কঠিনই, যদি না দেশীয় প্রজাতির মাগুর আমরা ফিরিয়ে আনতে না পারি। সন্দেহ নেই, বিপুল জনসংখ্যার দেশে বিপুল চাহিদাও দৈত্যকায় মাগুর মাছ সম্প্রসারণের অন্যতম প্রধান কারণ। সেক্ষেত্রে বিলে-ঝিলে, প্রাচীন পুকুরে টিকে থাকা দেশীয় মাগুর মাছের জাত উন্নয়ন করা যেতে পারে। নেওয়া যেতে পারে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি। দেশীয় মাগুর সংরক্ষণ ও জনপ্রিয় করতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো 'মাগুর মাস' ঘোষণা দিলেই-বা কেমন হয়?
skrokon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.