সড়ক যোগাযোগ-এ মৃত্যুর মিছিল রুখতে হবে by তোফায়েল আহমেদ

সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা, হার ও মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল। এ মিছিলে শামিল সব শ্রেণী-পেশা, বয়স ও লিঙ্গের মানুষ। কৃষক, শ্রমিক, বস্তির পথশিশু থেকে সচিব, চলচ্চিত্র ও গণমাধ্যম জগতের দিকপাল। রাজধানী থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত এ মহামারির বিস্তার। প্রতিবছর মৃত ১৪-১৫ হাজার।


পঙ্গুত্ব আরও অনেক বেশি। সড়ক দুর্ঘটনা পৃথিবীর সব দেশেই হয়, আমাদের দেশেও হবে। তাই বলে এত বিপুল সংখ্যা ও এত উচ্চ হার কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। দেশের সরকার ও জনগণ—সবাই মিলে সড়ক দুর্ঘটনার এ মহামারির প্রবণতাকে রুখতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনা যৌক্তিক হারে হ্রাস করার জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া দরকার, তা সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগে হতে হবে। দু-একটি বিভাগের বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপ এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। তার সঙ্গে যুক্ত হতে হবে বেসরকারি ও নাগরিক উদ্যোগ। যুক্ত হতে হবে প্রতি যানবাহনের মালিক, চালক ও যাত্রীসাধারণকে। এ ক্ষেত্রে সবার উদ্যোগ ও সম্পৃক্ততা হতে হবে সম্মিলিত, যুগপৎ ও সাংবাৎসরিক। প্রথমেই সড়ক দুর্ঘটনা-পরিস্থিতির সূক্ষ্ম ও চুলচেরা বিশ্লেষণ করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশের বিশেষায়িত শাখা, বিআরটিএ এবং তাদের সহায়তা করতে পারে বিভিন্ন গবেষণা ও নাগরিক সংস্থা। এই বিশ্লেষণের পর যে পদক্ষেপগুলো জরুরি এবং তাৎক্ষণিক, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি—এভাবে বিভক্ত করতে হবে। জরুরি ও তাৎক্ষণিক যে পদক্ষেপগুলো নিতে হবে তা হচ্ছে: মহাসড়কে টহল বৃদ্ধি, গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ, দ্রুতগতিসম্পন্ন যানবাহনের চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং দ্রুত দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর ও খবরাখবর আদান-প্রদানব্যবস্থার উন্নতি, হাইওয়ের দুর্ঘটনাকবলিত মানুষের চিকিৎসার বিশেষ ব্যবস্থা। স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে পুলিশের কার্যক্রমে প্রাধান্য পাবে ফিটনেসবিহীন যানবাহন প্রত্যাহার এবং ভুয়া অথবা লাইসেন্সবিহীন চালকদের গ্রেপ্তার। এ ক্ষেত্রে মালিকদের বিরুদ্ধেও ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবস্থা নিতে হবে; ব্যবস্থা নিতে হবে এসব যানবাহন শনাক্ত ও চালকের বিরুদ্ধে অভিযানকালে অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধেও।
একই সঙ্গে দেশে বর্তমানে যানবাহন-চালকদের প্রশিক্ষণসুবিধা কারিকুলাম, শারীরিক ও মানসিক যোগ্যতা এবং সর্বোপরি চালকের লাইসেন্স দেওয়ার পদ্ধতি নতুনভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। দেশে আধুনিক ও মানসম্মত ড্রাইভিং ট্রেনিং স্কুল কি আদৌ আছে? থাকলে সেখানকার প্রশিক্ষকদের যোগ্যতার মাপকাঠি কী? নাকি শুধু একজন ওস্তাদের অধীনে সহকারী বা হেলপার হিসেবে কাজ করতে করতে চালক হয়ে যাওয়াটাই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে আধুনিক ও মানসম্মত ‘চালক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান’ গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের ওপর বিআরটিএর নজরদারি থাকতে হবে। সরকার-সমর্থিত যানবাহন শ্রমিক বা মালিক সংস্থার সুপারিশে বিনা পরীক্ষায় ‘ড্রাইভিং লাইসেন্স’ ইস্যু করার নজির দুনিয়ার কোনো দেশে আছে বলে জানা নেই। এটি সম্ভবত ইতিহাসের বাংলাদেশেরই প্রথম রেকর্ড। আবার এ কাজের হোতা সরকারের একজন মন্ত্রী! এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের স্পষ্ট বক্তব্য থাকা দরকার। পরীক্ষা গ্রহণ, লাইসেন্স ইস্যু এবং জাল লাইসেন্স ইত্যাদিতে বিআরটিএসহ একটি চক্র কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে যাচ্ছে। এটি কোনো গোপন বিষয় নয়। কিন্তু যুগের পর যুগ বিষয়টি নীরবে সহ্য করে যাওয়া হচ্ছে। সড়কব্যবস্থায় সুশাসন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে এ গুরুতর অনিয়মের অবসান প্রয়োজন। দেশের সড়কগুলোতে যে সংখ্যায় যানবাহনের নিবন্ধন রয়েছে, ড্রাইভিং লাইসেন্স তার চেয়ে এক লাখ কম। তাহলে ওই এক লাখ যানবাহন কারা চালাচ্ছেন? আমি ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য গত দুই বছরে চারজন চালক পেয়েছি, যাঁদের প্রত্যেকের লাইসেন্স জাল বা ভুয়া। তাঁদের রাস্তার ট্রাফিক পুলিশ পাকড়াও করেছে। পরে আবার সেসব লাইসেন্স ফেরতও দিয়েছে। তাঁরা দিব্যি রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছেন।
দেশে কর্মরত বেসরকারি বাস-ট্রাক ও ব্যক্তিগত গাড়ির চালকদের দৈনিক সর্বাধিক কর্মঘণ্টা, বিশ্রাম, ছুটি, নিয়মিত শারীরিক যোগ্যতার পরীক্ষা, বিমাসুবিধা ইত্যাদি কোনো নিয়মনীতি মানা হয় না। এ বিষয়ে একটি নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন দরকার। চালকদের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা না দিয়েও তাঁদের সব সময় দোষী করা যাবে না; তাঁদের দিক থেকেও বিষয়টি দেখতে হবে।
আমাদের সড়কপথে দুর্ঘটনার সঠিক সংখ্যা জানার উপায় নেই। তথ্য পরিসংখ্যানে যা পাওয়া যায় তা সঠিক নয়। কারণ দুর্ঘটনার শিকার হয়েও অনেকেই পুলিশের কাছে যায় না। পুলিশ ক্ষেত্রবিশেষে যথাযথভাবে মামলা নথিভুক্ত না করেই নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা করে দেয়। এ দায়িত্ব আইন অনুযায়ী পুলিশকে দেওয়া হয়নি। কিন্তু এসব অহরহ ঘটছে। দুর্ঘটনায় যানবাহনের মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি, আহতকে হাসপাতালে না নেওয়া হলে কিংবা কারও মৃত্যু না হলে সাধারণত মামলা হয় না। যেসব মামলা হয় সেসবের নথি এত দুর্বল থাকে যে শেষ পর্যন্ত আদালত সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না। তা ছাড়া সাক্ষীর অভাবেও মামলা শেষ পর্যন্ত ডিসমিস হয়ে যায়। এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পুলিশের সড়ক ও যানবাহন শাখা, আদালত এবং ঘটনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শিকারেরা কীভাবে নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবস্থা নেবেন, সেটি নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে ভাবতে হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পর বড় দায়িত্ব এসে পড়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগ তথা যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের ওপর। কারণ সড়ক নির্মাণ, মেরামত, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে তারাই দায়িত্বপ্রাপ্ত। তা ছাড়া মহানগরের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন সড়ক মেরামত এবং সড়ক-নিরাপত্তার দায়িত্ব রয়েছে। সড়ক পরিকল্পনা ও নির্মাণত্রুটি, সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে যথাযথ জরিপ না করা এবং পরিকল্পনা ও নকশার ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির জ্ঞান কাজে না লাগানোর বিষয়টিও আমলে নেওয়া প্রয়োজন। সবকিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি সর্বক্ষেত্রে সর্বনাশের মূল তা হচ্ছে, চুক্তিবদ্ধ কাজের ঠিকাদুার নিয়োগ এবং ঠিকাদারের কাজের গুণ ও মান নিয়ে সর্বনাশা ব্যবস্থা। প্রথমত, যেসব সরকারি বিভাগের নির্মাণকাজের ঠিকাদার নিয়োগের দায়িত্ব রয়েছে, তাদের অসুবিধার কথাগুলো আমরা কেউ শুনছি না। ঠিকাদারিতে যে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন চলছে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে। তথাকথিত ‘ত্যাগী’ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে বা পুরো একটি চক্রকে কিছু আর্থিক সুবিধা দেওয়ার জন্যই যেন ঠিকাদার নিয়োগ। অনেক সময় এমনকি কাজের বাহানা সৃষ্টি করা হয় বিশেষ কাউকে ঠিকাদারির মাধ্যমে অর্থ পাইয়ে দেওয়ার জন্য। সে ক্ষেত্রে ঠিকাদারের কাজ করার সময় কাজের তত্ত্বাবধান এবং কাজ শেষে কাজের গুণগত মান যাচাইয়ের পুরো ব্যবস্থা সাংঘাতিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। ফলাফল হয় নির্মাণ-বিপর্যয়। তাই দীর্ঘ মেয়াদে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এবং এলজিইডিকে সড়ক নির্মাণের সঠিক কারিগরি গুণ ও মান নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে, বিশেষ করে রাজনৈতিক ঠিকাদার ও পেশাদার ঠিকাদারের পার্থক্য করেই কাজ দিতে হবে। গুণ ও মানসম্পন্ন কাজের স্বার্থে পেশাদার ঠিকাদার নিয়োগ করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আজকাল দেশের সব অবকাঠামো নির্মাণকার্যক্রমে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও নির্মাণকাজের ঠিকাদারি থেকে নেতাদের সহজ উপার্জন একটি সাধারণ প্রবণতা হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের দু-এক টন গমের কাজ থেকে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এবং এলজিইডির সড়ক—সর্বত্র এ সর্বনাশা প্রবণতার বিস্তার। সরকারি বিপুল অর্থ ব্যয়ে ত্রুটিযুক্ত ও নিম্নমানের নির্মাণ একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানিকগঞ্জ ট্র্যাজেডি ও ময়মনসিংহ-ঢাকাসহ দেশের বেশ কিছু আন্তজেলা সড়কপথে মালিকদের যানবাহন চালনার অস্বীকৃতির দুটি ঘটনা যদিও কাকতালীয়। কিন্তু যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এখন সবার তোপের মুখে। তাই তারা তড়িঘড়ি করে মেরামতের কাজ শুরু করছে। ওই মেরামত কাজে একইভাবে রাজনৈতিক কর্মী পোষণের বিষয়টি সামনে চলে আসছে। এ ক্ষেত্রে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী বা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী অসহায়। তাই নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের দরপত্র আহ্বান, পেশাদার ঠিকাদার নিয়োগ, ঠিকাদারের কাজের গুণগত মান নিশ্চিত করার বিষয়টি জরুরি। দেশের প্রতিটি সড়ক, মহাসড়ক, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন যার অধীনে সেই সড়ক, তার রুটিন রক্ষণাবেক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ-কাজের একটি সুনির্দিষ্ট সময়সূচি মেনে চলা সবার জন্য আবশ্যক হওয়া উচিত। বর্ষার আগে এবং বর্ষার পরে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করলে সড়কের বড় ক্ষতি হতে পারে না। সড়কসহ সব ভৌত অবকাঠামোর মালিক ও নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিটি সরকারি বিভাগের রক্ষণাবেক্ষণের পৃথক বাজেট এবং রুটিন রক্ষণাবেক্ষণ কার্যসূচি নিশ্চিত করা উচিত।
আমাদের সড়ক দুর্ঘটনার কারণ যেমন একাধিক, তার সমাধানের জন্যও তাই স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম প্রয়োজন। প্রয়োজন কাজের সমন্বয়। শুধু সড়ক দুর্ঘটনা নয়, এ দেশে অপঘাতে মৃত্যু বা অস্বাভাবিক মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এ মৃত্যুর সংখ্যা অনেক যুদ্ধরত দেশের বছরান্তে মৃত্যুর হিসাবের চেয়ে বেশি বই কম নয়। সে মৃত্যু তথাকথিত ক্রসফায়ার, গণপিটুনি, সামান্য কারণে কুপিয়ে-পিটিয়ে হত্যা, এমনকি আত্মহত্যা বহুভাবে সংঘটিত হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনাও ওই সব থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সব দুর্ঘটনা ও অপঘাতের কিছু সাধারণ কারণ বা সূত্র থাকে। আমাদের দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হচ্ছে ক্রমবর্ধমান সার্বিক সামাজিক অস্থিরতা। স্বাভাবিক ও সুস্থ সমাজজীবন আজ বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত। সমাজের প্রতিটি মানুষ প্রতিদিন কোথাও না কোথাও, কোনো না কোনো কারণে বিক্ষুব্ধ। রাগ, হতাশা, ক্ষোভ, উত্তেজনা ও অশান্তির মধ্যে কেউই সুস্থ-স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে না। এ অসুস্থ ও অস্বাভাবিক সামাজিক আচরণ চালক, যাত্রী, মালিক, জনতা সবাই নিজের অজান্তেই হয়তো করছি। সমাজে দিনে দিনে বাড়তে থাকা অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে । সেসব অস্থিরতার উৎসমুখ বন্ধ করার জন্য সরকার ও নাগরিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। একটি সুস্থ-স্বাভাবিক সমাজজীবনই পারে অপঘাত ও দুর্ঘটনার সংখ্যা ও হার ব্যাপকভাবে কমাতে।
ড. তোফায়েল আহমেদ: শিক্ষক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
ahmedt_dr@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.