চালচিত্র-লাদেনমুক্ত হলেও পৃথিবী সন্ত্রাসমুক্ত হয়নি by শুভ রহমান

ওসামা বিন লাদেন বিশ্ব সন্ত্রাস, বিশেষ করে ধর্মীয় সন্ত্রাসের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ধর্মকে, ইসলাম ধর্মকে উগ্র ও হিংস্র সাম্প্রদায়িকতার মোড়কে পুরে বিশ্বময় ছড়িয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করাই ছিল তাঁর মিশন। অবশ্য সেও ছিল এক রাজনৈতিক সন্ত্রাসেরই ধরন।


তাঁর বিনাশে বিশ্ব নিশ্চিতভাবেই এক মহাত্রাস, এক বিপজ্জনক সন্ত্রাসের কবল থেকে মুক্ত হয়েছে। কিন্তু তাই বলে বিশ্ব সামগ্রিকভাবে সন্ত্রাসমুক্ত হয়ে গেল মনে করলে মারাত্মক ভুল হবে।
ওসামা প্রতিষ্ঠিত আল-কায়েদা নেটওয়ার্ক এরপর ভেঙে পড়বে, নাকি মোল্লা ওমর, জাওয়াহিরি প্রমুখ লাদেন অনুসারীদের নেতৃত্বে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে, তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা চলছে। কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চিত, রাজা মাত হয়ে গেলে খেলা আর চলে না। খেলা কার্যত সাঙ্গ হয়ে যায়।
সন্ত্রাসবাদের ব্যাপারটা তা-ই। আমাদের দেশে সিরাজ সিকদার কিছুকালের জন্য সন্ত্রাসী চরম পন্থা অবলম্বন করে হিরো হতে পেরেছিলেন, অনেক তরুণকে বিপথগামী ও বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন; কিন্তু তাঁর পতনেই তাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সব 'মিথ' ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। হাজার চেষ্টা করেও তাকে আর খাড়া করা যায়নি। চারু মজুমদারের ব্যাপারটাও তা-ই। 'চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান' স্লোগান তুলে দিয়ে চীন অনুসৃত প্রকৃত রাজনৈতিক লাইনের এক বিকৃত রূপ এই উপমহাদেশে চালু করে সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধ্বংস সাধনের সুচতুর প্রয়াস চালিয়েছিলেন তিনি। অনেকের মতে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর ইন্ধনেই।
চারু মজুমদারের মিথও তাঁর বিনাশের সঙ্গে সঙ্গেই কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিল। জঙ্গল সান্তাল, কানু সান্যাল_কেউই আর চারু মজুমদারের লাইনকে এগিয়ে নিতে পারেননি। কানু সান্যাল তো শেষে আত্মহত্যাই করেছিলেন। জোর করে আর সিএমের অতি বাম হঠকারী ও চরমপন্থী সশস্ত্র বিপ্লবের লাইন আঁকড়ে ধরে এ দেশে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক গোষ্ঠী এবং ব্যক্তি-নেতৃত্ব 'সিএম' লাইনকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও এ দেশে রাজনীতি সচেতন গণমানুষের কাছে ব্যাপকভাবে তাঁরা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। ভারতে কিংবা নেপালে অবশ্য মাওবাদী রাজনীতির প্রসার ঠিক সিএমের লাইনে ঘটছে না। এ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এখন পর্যন্ত যেসব ক্ষুদ্র চরমপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী 'লাল পতাকা', 'জনযুদ্ধ', 'বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি' ইত্যাকার নানা নামে অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে, তারা প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম, লুণ্ঠন ইত্যাদি চালিয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধারেই ব্যস্ত। তারা নিজেদের বামপন্থী বা বিপ্লবী বলে দাবি করলেও কার্যত তারা বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমান প্রমুখ উগ্র সাম্প্রদায়িক সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীরই অপর পিঠ মাত্র। ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক মহাজোট সরকারের প্রশাসনিক এবং সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেই দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কিংবা দুর্গম পার্বত্যাঞ্চলে নানা রকম উগ্র ও সশস্ত্র কার্যকলাপ চালিয়ে দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধ্বংসের ব্যর্থ প্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে।
স্পষ্টত, দেশের মুষ্টিমেয় গোঁড়া ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক মানুষই দেশের শাসক মহাজোটের ক্ষতি সাধন এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্টে আহ্লাদিত হয়ে থাকে। শুধু তারাই ওসামা বিন লাদেনের পতনে ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হতে পারে। দেশের বাকি শতকরা ৯৯ ভাগ শান্তিপ্রিয় মানুষই লাদেনের বিনাশে যারপরনাই স্বস্তিবোধ করছে; এবং আর যেন কোনো লাদেনের উদ্ভব না ঘটে, কায়মনোবাক্যে সেই কামনাই করছে।
ইতিহাস সত্য হলে বস্তুত সেটাই অনিবার্যভাবে ঘটবে। শুধু সিএম বা এসএস নয়, ইতিহাসের চেঙ্গিস, হালাকু, নাদির শাহ, হিটলার, মুসোলিনি, তোজো, ফ্রাংকো, আইয়ুব, ইয়াহিয়া_কেউই আর ব্যক্তি হিসেবে ফেরত আসেননি, পুনরুজ্জীবিত হননি। তাঁদের অনুসৃত পন্থাও বিকৃত ও মানবসভ্যতাবিরোধী; এবং বিধ্বংসী আদর্শ এই শান্তির ধরাধামে টিকতে পারেনি।
মানুষ শান্তি চায়। শান্তিই সব মানবিক উন্নয়ন ও গুণের, মানব সংস্কৃতির বিকাশের প্রধান শর্ত। ওসামা গেছেন, মানুষ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। কিভাবে কার হাতে ওসামার বিনাশ ঘটল, মানুষ এ মুহূর্তে তা বিচার করতে যাবে না। তাঁকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তাঁর স্মৃতি বহন করা কিংবা মূর্তি স্থাপন তো তাঁরই বহুল প্রচারিত আদর্শের পরিপন্থী হবে। লাদেনের হিংসাশ্রয়ী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শই তো ২৫০০ বছরের বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসের ইন্ধন জুগিয়ে ইতিহাসে চরম বর্বরতার নিদর্শন রেখে দিয়েছে। আজ কী করে তাঁর অনুসারীরা তাঁর স্মৃতি বুকে ধারণ করে বেড়াবে!
ওসামা বিন লাদেন ধনাঢ্য সৌদি পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়েও নানা দেশে আত্মগোপন করে বিদেশি সহায়তায় বিপুল অর্থ ও অস্ত্রসম্ভারের অধিকারী হন এবং আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের ছত্রছায়ায় বিশ্বব্যাপী সশস্ত্র আল-কায়েদা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন (স্টিভ কোলের 'দ্য বিন লাদেনস' দ্রষ্টব্য)। বস্তুত পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের মৌলবাদীদের মদদেই তাঁর তথাকথিত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মিশন আল-কায়েদা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সফল করার দীর্ঘ প্রয়াস চলছিল। বলা হয়ে থাকে, ৯/১১-এর নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার ধ্বংস এবং পেন্টাগনে হামলা লাদেনেরই কাজ। বস্তুত বিভিন্ন মূল্যবান স্থাপত্য ও ইমারত এবং পুরাকীর্তি ধ্বংসই লাদেনের কীর্তি হিসেবে 'কীর্তিত' হবে। সভ্যতাবিধ্বংসী হিটলার যেমন চিরকাল এই গ্রহের বাসিন্দাদের ঘৃণা কুড়াবেন, তেমনি লাদেনের ললাটেও সেই সিল-ছাপ্পর মারা হয়ে গেছে। পৃথিবীর যেখানেই নরমেধযজ্ঞ চলেছে, সাম্প্রদায়িক হানাহানি দেখা দিচ্ছে, নৃশংস নারী নির্যাতন চলছে, মধ্যযুগীয় বর্বরতা ও সন্ত্রাসী তাণ্ডব চলছে, সবখানেই খোঁজ নিলে দেখা যাবে, লাদেন এবং তাঁর আল-কায়েদা নেটওয়ার্কের ছড়িয়ে দেওয়া সহিংসতার বিষবাষ্পই সেখানে পুঞ্জীভূত হয়ে সব অঘটন ঘটিয়ে চলেছে। অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার, অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতা ও জঙ্গিবাদসহ সমাজের সার্বিক পশ্চাৎপদতাকে টিকিয়ে রাখা, সমাজটাকে হাজার বছর পেছনে ঠেলে দেওয়াই লাদেনের আল-কায়েদার কাজ। পাকিস্তানে প্রায় নিত্যই গাড়িবোমায় মানুষ অকালে প্রাণ হারাচ্ছে, মসজিদে গুলি-বোমা হামলায় ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি হামলায় নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশু প্রাণ দিচ্ছে_সর্বত্রই আল-কায়েদার ইন্ধন ও যোগসাজশে উগ্র সশস্ত্র সাম্প্রদায়িক শক্তিরই অভিযান লক্ষ করা যাবে।
আমাদের দেশেও রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এসব ভয়াবহ প্রাণসংহারী বোমা-গুলির হামলায় অসংখ্য মানুষের প্রাণ গেছে। সেগুলোর পেছনেও দেশীয় সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ও আল-কায়েদারই অস্তিত্ব বিদ্যমান। লাদেন গেছে বলেই সেসব অপতৎপরতা জাদুমন্ত্রে চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে মনে করলে মূর্খের স্বর্গেই বাস করব আমরা। লাদেনের যারা স্রষ্টা, অর্থ ও অস্ত্রসম্ভার দিয়ে যারা লাদেনকে সারা বিশ্বে সুস্থ গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করার ধ্বংসাত্মক যন্ত্র বানিয়েছিল, তারা_সেই সভ্যতার দুশমন সাম্রাজ্যবাদ কিন্তু অক্ষত ও বহাল তবিয়তেই রয়ে গেছে। পৃথিবীর বুকে লাদেন নেই। কিন্তু যতক্ষণ সাম্রাজ্যবাদ টিকে আছে, ততক্ষণ সন্ত্রাস থাকবে। যেমন ফ্যাসিবাদ পরাজিত হয়েও নানা আকারে টিকে আছে। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ তো ফ্যাসিবাদেরই নতুন চেহারা। সন্ত্রাসমুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলতে হলে সাম্রাজ্যবাদমুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

১০.০৫.২০১১

No comments

Powered by Blogger.