সাদাকালো-ফতোয়া : নানামত ভিন্নমত by আহমদ রফিক

ফতোয়া নিয়ে বাঘা বাঘা আইনজীবীর আইনি সূক্ষ্মতার অভিমতের বিরুদ্ধে কিছু বলতে যাওয়া বিপজ্জনক। তবে ভরসা এই যে অন্তত আদালত অবমাননার দায়ে পড়তে হবে না। ফতোয়ার অমানবিকতার বিবেচনায় দেখছি, আদালত ও বিচারপতিরাই মানবিক যুক্তির পথ ধরে হাঁটছেন।


তাঁরা আইনি মারপ্যাঁচের জটিলতায় না গিয়ে সহজ যুক্তি, সহজ বুদ্ধির সাহায্য নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন, যাতে মানবকল্যাণের দিকটা প্রাধান্য পায়। আইন তো মানুষের কল্যাণ, মঙ্গল ও সুস্থ জীবনযাত্রায় সাহায্যের জন্য। মানুষের সহজ বুদ্ধি ও মনীষীদের গভীর চিন্তা এমন কথাই বলে।
নওগাঁয় স্ত্রীকে তালাক দেওয়া এবং আবার গ্রহণ করার বিষয়ে প্রদত্ত ফতোয়ার বিরুদ্ধে ২০০১ সালে বিচারপতি গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার বেঞ্চ ফতোয়া অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী বলে যে ঐতিহাসিক ও মানবিক রায় দেন, তার বিরুদ্ধে মুফতি ও মাওলানা সাহেবদের আপিলের শুনানি চলছে। আর এ উপলক্ষে আধুনিক, উচ্চশিক্ষিত, অভিজ্ঞ, প্রবীণ আইনজীবীদের মতামত শুনে তাজ্জব বনেছি। মনে হয়, তাঁরা বিরাজমান বাস্তবতার হিসাব-নিকাশ না করে আইনি বিচার-ব্যাখ্যায়ই গুরুত্ব ও মনোযোগ দিয়েছেন।
প্রবীণ আইনজীবী টি এইচ খান ফতোয়া বৈধ বিবেচনা করে মন্তব্য করেছেন যে 'ফতোয়া নিষিদ্ধ হলে দেশে যৌতুক প্রথা বেড়ে যাবে, ইভ টিজিং ও নারী নির্যাতন বেড়ে যাবে' (কালের কণ্ঠ, ২৬ এপ্রিল, ২০১১)। গত কয়েক বছরে ইভ টিজিং ও নারী নির্যাতনের যেসব খবর কাগজে বেরিয়েছে (প্রকৃত সংখ্যা সম্ভবত অনেক বেশি) তাতে ফতোয়ার সঙ্গে ওই সংখ্যা বাড়া-কমার কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। বরং দেখা গেছে, ফতোয়া বরাবর নারী নির্যাতনের পক্ষে গেছে এবং সুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নির্যাতনকারী পুরুষের পক্ষে। ফতোয়ায় নির্ধারিত দোররা ও শাস্তির কারণে অনেক নারীর মৃত্যু ঘটেছে বা তাঁরা অপমানে আত্মঘাতী হয়েছেন। এ হলো গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত ফতোয়ার পরিণাম। পুরুষশাসিত সমাজের বিবেক সেখানে স্তব্ধ, অর্থাৎ পুরুষের পক্ষে। তাই বাস্তব ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে জনাব খানের মন্তব্য মানবিক চেতনার প্রাধান্য আমাদের প্রত্যাশিত ছিল।
প্রবীণ ব্যারিস্টার রফিকুল হকও ফতোয়ার পক্ষে; কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও বলেন যে 'ফতোয়ার নামে কাউকে শাস্তি দান অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।' বিরাজমান বাস্তবতা হলো ফতোয়ার মাধ্যমে দোররা মারার মতো শাস্তিদান গ্রামাঞ্চলে বা ছোটখাটো শহরে হরহামেশা ঘটছে, দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরাদি তেমন কথাই বলে। আর সে ক্ষেত্রে নির্যাতিত অসহায় (অধিকাংশ ক্ষেত্রে দরিদ্র) নারীর পক্ষে কি জনাব রফিকুল হকের নির্ধারিত 'ফৌজদারি আইনের আদালত' পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব? কখনোই না। এর পরও থাকে স্থানীয় প্রভাবশালীদের হুমকি ও দাপট।
তবে অন্য আইনবিশেষজ্ঞ ড. জহির বলেন, 'ফতোয়া একটি অভিমত। এটা ইসলামী শরিয়তের অংশ নয়। ফতোয়ার নামে কারো জীবনের ওপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না। ফতোয়ার মাধ্যমে কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না' (প্রাগুক্ত)। ড. জহিরের অভিমত স্পষ্ট। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ফতোয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে শাস্তিদান এবং তা মূলত নারীকে, পুরুষকে নয় এবং পুরুষকে ক্ষেত্রবিশেষে শাস্তি দেওয়া হলেও তা নামকাওয়াস্তে, লোকদেখানো।
ভাবতে অবাক লাগে, আমাদের বিশেষজ্ঞ আইনজীবীরা কি সংবাদপত্র পড়েন না? হয়তো তাঁদের কর্মব্যস্ততা সে ক্ষেত্রে বড় বাধা, তবু তাঁদের পেশার কারণেই বোধ হয় কাগজ পড়াটা জরুরি। তাহলে দেখতে পেতেন ফতোয়াবাজি কত নারীর সর্বনাশ করেছে, জীবন নিয়েছে।
এখন লিখতে হচ্ছে, যখন দেখছি ফতোয়াবাজি নিয়ে দুটো ভিন্নমত দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আমি মুফতি বা মাওলানা সাহেবদের কথা বলছি না। কারণ, তাঁরা তো ফতোয়ার পক্ষেই রায় দেবেন। কিন্তু শঙ্কিত হচ্ছি দেখে যে আমাদের শীর্ষস্থানীয় আইনবিশেষজ্ঞরা, যাদের অভিমত আমাদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, তাঁদের কেউ কেউ ফতোয়া বৈধ বলে মনে করেন। হয়তো করেন আইনের সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচে, কিন্তু বাস্তবে এর ভয়াবহতা তাঁদের চোখে পড়ে না বা পড়লেও তা গুরুত্ব পায় না।
ফতোয়াবাজির মাধ্যমে অযৌক্তিকভাবে ধর্মের নামে ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা যে লঙ্ঘিত হচ্ছে বা কালের বহুকথিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল তা ভেবে দেখেননি প্রথমোক্ত আইনবিশেষজ্ঞ। অথচ মানবাধিকার, ব্যক্তির যৌক্তিক অধিকার রক্ষায় গোটা বিশ্ব অনেক দিন থেকেই সোচ্চার। আর সে টানে আমাদের এলিট শ্রেণী বা সুশীল সমাজও অসমান। কিন্তু প্রদীপের নিচে যে গাঢ় অন্ধকার এবং মানবাধিকার, ব্যক্তির অধিকার ফতোয়াবাজির নামে, কথিত ধর্মীয় আইন রক্ষার নামে প্রবলভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে, তা ওই এলিট পেশাজীবী অনেকেরই নজরে আসে না। এটা দুর্ভাগ্যজনক।
বিশেষজ্ঞদের কারো কারো মতামতে এক ধরনের অদ্ভুত, প্রচ্ছন্ন স্ববিরোধিতা লক্ষ করার মতো। কারণ, যিনি মনে করছেন ফতোয়া দেওয়া জায়েজ, তিনি আবার একই সঙ্গে বলছেন যে ফতোয়ায় যেন কারো অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়। অ্যামিকাস কিউরি এ এফ হাসান আরিফ বলেছেন, 'ফতোয়া অবৈধ নয়, কিন্তু ফতোয়ার কারণে যদি কারো ক্ষতি হয়, তাহলে ওই ফতোয়াদানকারীকে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে' (কালের কণ্ঠ, ২৮.৪.২০১১)। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কে দেবে ফতোয়াদানকারীকে শাস্তি? আদালত? আদালতের সে এখতিয়ার আলেম সমাজ মেনে নেবে? অন্য এক অ্যামিকাস কিউরি এ বি এম নুরুল ইসলাম ফতোয়াকে মৌলিক অধিকার বলে মনে করেন। তাঁর মতে, 'ফতোয়া দেওয়ার অধিকার মুফতিদের রয়েছে। সেটা হতে হবে কোরআন ও হাদিসের আলোকে।' তবে তাঁরও কথা, 'ফতোয়ার নামে কারো অধিকার ক্ষুণ্ন করা হলে ওই ফতোয়াবাজির শাস্তি হতে পারে' (প্রাগুক্ত)। এখানেও পূর্বোক্ত স্ববিরোধিতা।
আবারও প্রশ্ন, কোরআন-হাদিসের ভিত্তিতে প্রদত্ত ফতোয়া যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে তা কি বাতিল বলে গণ্য হবে এবং মুফতি বা মাওলানারা তা মেনে নেবেন? পুনরাবৃত্তি সত্ত্বেও আবারও বলি, কাগজে যেসব ফতোয়াবাজির খবর আমরা পড়ি, তাতে শুধু ব্যক্তির অধিকারই ক্ষুণ্ন হয় না, ব্যক্তিটি অর্থাৎ নারী অন্যায়ের শিকার হয়। কখনো ঘটে মৃত্যু।
ফতোয়াবাজির বৈধতা মেনে নিতে হলে আমাদের সমাজে দ্বৈত বিচারের ব্যবস্থা মেনে নিতে হয়। তাতে বিচারিক ব্যবস্থায় জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না। একুশ শতকের আধুনিকতায় পেঁৗছে আমরা যদি জীবনযাত্রার আধুনিকতার পাশাপাশি প্রাচীন ধর্মীয় বিধিবিধানের আওতায় সমাজকে পেছনের দিকে চালাতে চাই, সেটা কতখানি যুক্তিসংগত তা ভেবে দেখা দরকার।
আমরা রাষ্ট্রযন্ত্রকে গণতন্ত্রের মৌলিক অধিকারের ভিত্তিতে চালাতে চাই, মূল সংবিধান সে হিসেবেই রচিত হয়েছিল। এখন কোরআন-হাদিসের ভিত্তিতে চালাতে গেলে পদে পদে সংঘাত বা স্ববিরোধিতার মুখোমুখি হতে হবে। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে গণতন্ত্রকে সে ক্ষেত্রে ছেঁটে ফেলতে হবে। সেটা উন্নত বিশ্বের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, আইনবিশেষজ্ঞদের তা একবার ভেবে দেখতে বলি।
ফতোয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে পাঁচ আলেম যা বলেছেন, সেটাই প্রত্যাশিত। তাঁরা অতীতে পরিচালিত ফতোয়াব্যবস্থার প্রয়োজন ও কার্যকারিতা নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সমাজটা দেড় হাজার বছর আগেকার মতো নেই। একালে জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভাবিত উন্নতি ঘটেছে। বিচারব্যবস্থাও আধুনিক মানদণ্ডে গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। মধ্যযুগের কাজির বিচারব্যবস্থা বহুকাল আগে বিলুপ্ত।
তাই কোরআন-হাদিসের ভিত্তিতে ফতোয়াব্যবস্থার আইনগত স্বীকৃতি দিতে গেলে স্বাভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী তথা কোরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে চলতে অসুবিধা কোথায়? জামায়াত তো বরাবরই এ দাবিই আদায় করতে চেয়েছে। চেয়েছে বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্রে, ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করতে।
পাকজান্তা এবং জামায়াত ও ইসলামী দলগুলোর বিরুদ্ধে আদর্শগত মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশকে যদি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করতে হয়, তাহলে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম তার অর্ধেক তাৎপর্য হারায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের তাৎপর্য তো মোটেই ধর্মভিত্তিক ছিল না, ছিল আর্থ-জাতীয়তাভিত্তিক। আর স্বাধীন দেশে ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাস, নিশ্চিন্তে ধর্মাচরণ পালন করায় তো কোনো বাধা ছিল না, এখনো নেই।
তাহলে কেন বাংলাদেশ নামক একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ফতোয়ার বৈধতা দানে পশ্চিমা কেতায় শিক্ষিত এলিটদের সমর্থন, কেন আধুনিক গণতন্ত্রের পরিবর্তে সমাজে, রাষ্ট্রে ধর্মীয়তন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় তাদের অযৌক্তিক সমর্থন?
জানি না, আমাদের সর্বোচ্চ বিচার বিভাগ সব কিছু কোন বিবেচনার পর কোন পথ ধরবে। যুক্তি ও আধুনিক চেতনার চেয়ে ধর্মীয় স্পর্শকাতরতা কি বড় হয়ে উঠবে, নাকি একটা সমঝোতার পথ অগ্রাধিকার পাবে_অচিরেই তা জানা ও বোঝা যাবে। তবে ভাবতে অবাক লাগে, স্বাধীনতাযুদ্ধের এতকাল পর পরিত্যক্ত বিষয়গুলো নতুন শক্তি নিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। এর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের দায়দায়িত্ব কি আমাদের আধুনিক চেতনার নেই?

লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.