গ্যাস ব্যবহারে বৈষম্যমূলক নীতি by মনজুরুল হক

সস্তায় বা মুফতে পাওয়া বস্তুর অপব্যবহার বাংলাদেশে আজ নতুন নয়। মুদ্রাস্ফীতির এই বাড়-বাড়ন্ত সময়ে বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে পাইপলাইনে জ্বালানি গ্যাস পাওয়া যায়, এবং তা যে দামে পাওয়া যায়, তা বোধ করি বিশ্বের অন্যসব দেশের তুলনায় 'পানির দর'! মাসের ৩০ দিনে ২৪ ঘণ্টা দুটি বার্নারের চুলা জ্বালিয়ে রেখে সরকারকে দিতে হয় মাত্র ৪৫০ টাকা।


ডলারের হিসাবে মাত্র ৬.৪২ ডলার। এই ছয় ডলারে সারা মাস রান্না থেকে শুরু করে কাপড় শুকানো এবং ম্যাচের কাঠি সাশ্রয় করাসহ ৭২০ ঘণ্টা ডাবল বার্নার চুলা জ্বালিয়ে রাখা যায়! এটা আসলেই বিরল এক ঘটনা। তবে তা শুধু সেসব সৌভাগ্যবান ব্যক্তির জন্য, যারা পাইপলাইনের আওতায় বসবাস করে। অর্থাৎ ঢাকাসহ দেশের যেসব অঞ্চলে পাইপলাইনে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে, তারাই কেবল এই সুযোগ পেয়ে থাকে। এর বাইরে সারা দেশে আর যারা রান্নার জন্য গ্যাস ব্যবহার করে, তাদের তা কিনতে হয় ঠিক পাইপলাইনের সংযোগের তুলনায় ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতে প্রায় ১৮০০ থেকে দুই হাজার টাকায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নরসিংদী ও বগুড়াসহ কিছু অঞ্চল বাদে সারা দেশের মানুষকে ওই দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা ব্যয়ে মাস চালাতে হয়। একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল, যেখানে এখনো খড়-বিচালি কিংবা গাছের মরা ডালপালা বা পাতা দিয়ে রান্নার কাজ সারা যায়, তারা বাদে বিশাল বাংলায় এখন আর কম দামে জ্বালানি কাঠ বা চ্যালা কাঠ মেলে না। গাছপালা যা আছে, তার বেশির ভাগই সাবাড় হয় ইটখোলায়। আর বাংলাদেশে কয়লা দিয়ে একসময় জ্বালানির ব্যবস্থা হলেও এখন আর কোথাও কয়লার ব্যবহার নেই। রেলওয়েতে ডিজেল ইঞ্জিন আসার আগে যখন স্টিম ইঞ্জিনের চল ছিল, সেই সময় বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করা হতো। সেই সময় রান্নার জন্যও কয়লা ব্যবহারের চল ছিল, যা ডিজেল ইঞ্জিন আসার পর
বন্ধ হয়ে গেছে।
পাইপলাইনের বাইরে এই যে বিশাল জনগোষ্ঠী, যারা সিলিন্ডারের গ্যাস অর্থাৎ এলপিজি ব্যবহার করে, তাদের কাছে এই গ্যাস সস্তা এবং সহজলভ্য করার জন্য সরকারের অনেক পুরনো পরিকল্পনা আছে। কিন্তু তা কেবলই কাগজে-কলমে। এ যাবৎ তা বাস্তবায়িত হয়নি। আজ থেকে ১০ বছর আগে পাইপলাইনের গ্যাস দিয়ে শুধুই রান্নার কাজ চালাত মানুষ। গাড়িতে সিএনজি ব্যবহার শুরু হলেও এখন এটা বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাসের ব্যবহারকে ছাড়িয়ে গেছে। কিছুদিন আগেও একটি প্রাইভেট কারে একবার গ্যাস চার্জ করতে লাগত মাত্র ১২০ টাকা! ওই ১২০ টাকার গ্যাস ভরে সেই গাড়িটি সারা দিন চালানো যেত। এর ফলে যা হলো_রাতারাতি প্রাইভেট গাড়ির ব্যবহার দ্বিগুণ হয়ে গেল! যে চাকরিজীবী তার বেতনের টাকায় কোনোমতে সংসার চালায়, তারও ইচ্ছা হলো একটি গাড়ি কেনার। কোনোভাবে কিনে ফেললেই হলো। মাত্র ১২০ টাকায় সারা দিনের সফর! ওই সফরটুকু রিকশায় করলে লাগত প্রায় দ্বিগুণ। শুধু যে প্রাইভেট কার সিএনজি ব্যবহার করছে, তা নয়, রাতারাতি শহরে চলাচলকারী বাস, মিনিবাস, ট্রাক, মিনিট্রাক, মাইক্রোবাস, হাফ ট্রাক_সবই সিএনজিতে রূপান্তর হয়ে গেল। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠল সিএনজি ফিলিং স্টেশন। খুব অল্প জায়গা লাগে বলে যেকোনো সদর রাস্তার পাশে ধাই ধাই করে গড়ে উঠল সিএনজি ফিলিং স্টেশন। সেসব স্টেশনকে গ্যাস সাপ্লাই দিতে সরকার যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখন বাধ্য হয়ে এক দফা সিএনজি গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো। কিন্তু ঢাকার বাইরে সেই বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য এলপিজি গ্যাসের সহজলভ্যতা বা দাম কমানোর বিষয়টি আর কারো মাথায় এল না। পাইপলাইনের গ্যাস আর এলপিজি গ্যাসের দামের একটা তুলনামূলক চিত্র দেখুন_যারা সরকারি গ্যাস ব্যবহার করছে, সরকার তাদের দিয়ে রেখেছে অপচয়ের বিরাট সুযোগ। আর যারা বেশি খরচ করে এলপিজি ব্যবহার করছে, তাদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে উচ্চ হারে শুল্ক কর। এলপিজির কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে ১১ থেকে ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক গুনতে হচ্ছে কম্পানিগুলোকে। স্বাভাবিকভাবেই এই শুল্কের বোঝা বহন করতে হচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার এলপিজি ব্যবহারকারীদের।
'এলপি গ্যাসের দাম এত বেশি হওয়ার প্রধান কারণ উচ্চ শুল্ক। কম্পানিগুলোকে এলপিজি মিঙ্চার আমদানিতে ১১ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। এ ছাড়া সিলিন্ডারের ওপর ২৯, এলপিজি বাল্বের ওপর ৩৩, সেইফটি বাল্বের ওপর ২৮ এবং সিলিন্ডারের রেগুলেটরের ওপর ১১ শতাংশ শুল্ক ধার্য আছে। বর্তমানে দেশে ২০ লাখ আবাসিক গ্রাহক মোট গ্যাসের ৮-১০ শতাংশ ব্যবহার করে। বছরে ১০ শতাংশ করে আবাসিক গ্রাহক বাড়ছে। অপরদিকে, দেশে এলপিজির চাহিদা প্রায় এক লাখ টন। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্টার্ন রিফাইনারি ও কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্র থেকে বছরে পাওয়া যায় ২২ হাজার টন এবং বসুন্ধরা, যমুনা ও টোটালসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আমদানি করে ৫০-৬০ হাজার টন। সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় এলপি গ্যাস ব্যবহারকে উৎসাহিত করার কথা বলেছেন, এর থেকে শুল্ক কমানোর কথা বলেছেন। কিন্তু এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা আসেনি।' (কালের কণ্ঠ, ১৮.০৪.২০১১)
আশার কথা, সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, 'এলপিজির ব্যবহার বাড়াতে এর ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করা হবে। এ ছাড়া আবাসিক গ্যাসের দাম বাড়িয়ে এবং এলজিপির দাম কমিয়ে সমন্বয় করা হবে।'
এ ধরনের ঘোষণা আগের সরকারও দিয়েছিল। বর্তমান সরকারের আমলেও এর আগে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো ঘোষণাই বাস্তবায়িত হয়নি। আর এ কারণে আবাসিক এলপিজি ব্যবহারকারীদের দিনের পর দিন তার আয়-রোজগারের একটি বড় অংশ ব্যয় করতে হচ্ছে স্রেফ রান্নার গ্যাস কেনার জন্য। তাদের মনঃকষ্ট আরো বেড়ে যাচ্ছে, যখন তারা দেখছে, পাইপলাইনের সৌভাগ্যবানরা মাত্র ৪৫০ টাকা খরচ করে সারা মাসের জ্বালানির চাহিদা মেটাতে পারছে। যত দ্রুত সম্ভব এই বৈষম্য দূর করে গ্যাসের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, monjuraul@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.