চলতি পথে-বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি by দীপংকর চন্দ

বরিশাল সদরে অবস্থিত অক্সফোর্ড মিশন হাইস্কুলের খানিকটা সামনেই ঐতিহ্যবাহী পেশকারবাড়ি। ১৯৭১ সালে নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের এই বাড়িটি ঘিরেই মূলত পরিচালিত হতো বরিশাল আওয়ামী লীগের সিংহভাগ কার্যক্রম। পেশকারবাড়ির পুকুরঘাটে বসেই সম্পন্ন হয়েছিল ২৫ মার্চের পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণের জরুরি বৈঠক।


সে বৈঠকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত হয় দ্রুত অস্ত্র সংগ্রহের। সিদ্ধান্ত হয় যুদ্ধে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের। কিন্তু এই বিপুল কর্মযজ্ঞের আয়োজন তো পেশকারবাড়ির স্বল্পপরিসর আঙিনায় সম্ভব নয়! তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, স্বাধীনতাকামী ছাত্র-জনতা যেন পেশকারবাড়ি-সংলগ্ন সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে পরদিন সমবেত হন। গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারেই ঘটল সবকিছু। ২৬ মার্চ সকালে সবাই সমবেত হলেন সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে।
হাঁটতে হাঁটতে সেই সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সামনেই উপস্থিত হলাম আমরা। দ্বাররক্ষীর অনুমতিসাপেক্ষে প্রবেশ করলাম বিদ্যালয়ের ভেতরে। সেখানে সিমেন্টে ঢালাই করা পথ। সরু এই পথটি একটু এগিয়ে গিয়েই বিভক্ত হয়েছে দুটি শাখাপথে। একটি শাখাপথ সোজা চলে গেছে টিচার্স কোয়ার্টারের দিকে। অন্য শাখাপথটি খানিকটা বাঁয়ে এগিয়ে শেষ হয়েছে বিদ্যালয় ভবনের সামনে।
ইংরেজি ইউ আকৃতির সেই বিদ্যালয় ভবনের প্রশাসনিক কার্যালয়ে প্রবেশ করতে উদ্যত হলাম আমরা। কিন্তু সিঁড়িতে পা রেখেই থমকে গেলাম হঠাৎ! একটা আকর্ষণীয় স্থাপনা সেখানে! বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অনুকরণে নির্মিত স্থাপনাটি মূলত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্মারক। লাল-সবুজ বর্ণে উদ্ভাসিত এই স্মৃতিস্মারকের কেন্দ্রভাগে একটি বর্গাকার ফলক। ফলকগাত্রে স্পষ্টাক্ষরে উৎকীর্ণ ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দক্ষিণাঞ্চলীয় সূচনাকেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য স্বাধীন বাংলার দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রথম সচিবালয়’। হ্যাঁ, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বরিশালে যে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়, তাকে আরও পরিশীলিত, সুসংগঠিত করতেই নিশ্চিত করা হয় বাংলাদেশ সরকারের দক্ষিণাঞ্চলীয় পরিচালনা কাঠামো। সেই সঙ্গে বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়কে ঘোষণা করা হয় স্বাধীন বাংলার দক্ষিণাঞ্চলীয় সচিবালয় হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের অনন্য স্মৃতির অংশ সেই স্মারক স্থাপনাটির সামনে দাঁড়িয়ে পরিচয় হলো বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শংকর কুমার পালের সঙ্গে। তিনি আমাদের সংক্ষেপে জানালেন সংগ্রামে উত্তাল সেই সময়ের বিশেষ কিছু কথা।
বরিশালে তখন সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি চলছিল। সামরিক বাহিনীর সাঁজোয়া বহরের অফিসার মেজর জলিল তখন ছুটি কাটাতে এসেছিলেন তাঁর গ্রামের বাড়ি উজিরপুরে। জনসাধারণ তাঁকে বরিশাল সদরে এসে এই অঞ্চলের সামরিক কমান্ড গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানালেন। তিনি ২৬ মার্চ বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের জনসমাবেশে এলেন এবং গ্রহণ করলেন দক্ষিণাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডের দায়িত্ব। মেজর জলিল সেদিনই উপস্থিত আনসার, পুলিশ, ছাত্র, জনতার ভেতর থেকে বাছাই করে একটি বাহিনী গঠন করলেন এবং যুদ্ধের প্রাথমিক কিছু শিক্ষা দিলেন। অন্যদিকে বরিশাল আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতারা চালালেন অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহের অভিযান। নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, আমির হোসেন আমু, এনায়েত হোসেন চৌধুরী, এম জি কবির ভুলু, শেখ কুতুবুদ্দিন, লুৎফর রহমান, তসলিম বিন আজমসহ আরও কয়েকজনের সক্রিয় তৎপরতায় সাড়া দিয়ে পুলিশ লাইনের বাঙালি পুলিশরা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে সরাসরি যোগ দিলেন মুক্তিবাহিনীতে। তাঁরাও নিজেদের সাধ্য অনুসারে ছাত্র-জনতাকে শেখালেন রাইফেলে গুলি ভরার কৌশল, পিন অবমুক্ত করে চকিতে গ্রেনেড ছুড়ে মারার নিয়মনীতি।
এভাবেই যুদ্ধপ্রস্তুতি চলল দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর বরিশালে। ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাদের দেখা মিলল না বরিশালের সীমানায়। ১৭ এপ্রিল বরিশালের আকাশে দেখা গেল জঙ্গি বিমান। ১৮ এপ্রিল দুপুরে বরিশাল শহরে শুরু হলো পাকিস্তানি বিমান হামলা। জঙ্গি বিমানের আক্রমণ যে কী ভয়াবহ, তা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন বিমান বিধ্বংসী অস্ত্রবিহীন মুক্তিসেনারা। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, সম্মুখযুদ্ধে নয়, অতর্কিতে গেরিলা আক্রমণেই ঘায়েল করতে হবে পাকিস্তানি সৈন্যদের। ২৪ এপ্রিল ফরিদপুর দখল করে সড়কপথে বরিশালের দিকে এগোল পাকিস্তানিরা। ২৫ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর নৌ-কমান্ড মুক্তিসেনাদের শিকারপুর-দোয়ারিকা প্রতিরোধব্যূহ ধ্বংস করল। ২৬ এপ্রিলের মধ্যেই বরিশাল চলে গেল পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। অনিবার্য কারণেই পিছু হটতে বাধ্য হলেন মুক্তিসেনারা। কিন্তু এই পিছু হটা খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। মাত্র আট মাসের ব্যবধানেই পাকিস্তানি দুর্বৃত্তরা টের পেল, বাংলার মাটি মুক্তিকামী মানুষের দুর্জয় ঘাঁটি! এই ঘাঁটির দখল নেওয়া তাদের কর্ম নয়! ৮ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর বোমারু বিমান রহমতপুরের ছোট্ট বিমানবন্দরটি ধ্বংস করল। কীর্তনখোলা নদী তীরে পিআইডব্লিউটিএ জেটিও ডুবিয়ে দিল বিধ্বংসী বিমান আক্রমণে। নদীর অন্য পাড় দিয়ে আবদুল মান্নান ও সুলতান মাস্টারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল শহরে প্রবেশ করল। বেলা তিনটার দিকে লেজ গুটিয়ে পালানো শুরু করল পাকিস্তানি দখলদাররা। বরিশাল মুক্তাঞ্চল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রে।
দীপংকর চন্দ

No comments

Powered by Blogger.