আমেরিকার কালো অর্থনীতি বাংলাদেশের জিডিপির ১৯ গুণ by ড. আবু এন এম ওয়াহিদ

প্রতিটি দেশে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে অনেকটা গোপনে কিছু কাজ-কারবার ও লেনদেন হয়ে থাকে, যা কখনো জাতীয় আয়ের হিসাব-নিকাশের মধ্যে আসে না। এ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনৈতিক, বেআইনি এবং বিভিন্ন ধরনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে জড়িত।


অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। যেসব স্বামী কিংবা স্ত্রী স্বাভাবিক কর্মসংস্থানের বাইরে সংসার এবং শিশুসন্তানদের দেখাশোনা করে, তাদের কাজের মূল্যও জাতীয় আয়ের বাইরে; কিন্তু এটা বেআইনি নয়। এসব আইনি ও বেআইনি যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বলা হয় 'কালো অর্থনীতি', যা ইংরেজিতে 'আন্ডারগ্রাউন্ড ইকোনমি' বা 'শ্যাডো ইকোনমি'। আমেরিকার অর্থনীতি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে সম্পদশালী। বর্তমানে তার জিডিপির পরিমাণ ১৪ হাজার বিলিয়ন ডলারের ওপর। অনুরূপভাবে তার কালো অর্থনীতি বিশ্বেও সর্ববৃহৎ। বর্তমানে এর আকার প্রায় এক হাজার ৯ শত বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। যা কিনা বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ১৯ গুণ।
আমেরিকার কালো অর্থনীতির আকার ও তার হিসাব-নিকাশ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বেশ কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের মতে, এর আকার জিডিপির ১০ শতাংশ। আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বিভাগ সংক্ষেপে আইআরএস। তার মতে, আমেরিকার কালো অর্থনীতির পরিমাণ দেশের জিডিপির ১৫ শতাংশ। বিখ্যাত ওয়াল স্ট্রিট ম্যাগাজিন 'দ্য ব্যারনস'-এর নিয়মিত প্রতিবেদক জেমস ম্যাকট্যাগুরের মতে, আমেরিকার কালো অর্থনীতি তার জিডিপির ৯ শতাংশ। শিক্ষকতায় নিযুক্ত অর্থনীতিবিদরা অস্ট্রিয়ান গবেষক ফ্রেডরিক স্নাইডারের অনুমানকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন। স্নাইডারের মতে, এটা জিডিপির ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। স্নাইডার তাঁর হিসাব-নিকাশে বিদ্যুতের ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রাপ্রবাহকে উপাত্ত হিসেবে ব্যবহার করেছেন। স্নাইডারের হিসাবের একটা ত্রুটি হলো, তিনি মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আমেরিকায় আসা অসংখ্য বেআইনি অভিবাসীর আনাগোনাকে উপাত্ত হিসেবে আমলে নেননি। তাঁর হিসাবের এই ত্রুটি সংশোধন করার পর, স্নাইডার আরেকজন সহগবেষক ডমিনিক অ্যাসেন্টেকে নিয়ে এ বিষয়ে আরো ব্যাপক কাজ করেন। তাঁদের এই যৌথ গবেষণার ফলাফল ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস বই আকারে প্রকাশ করে। বইয়ের নাম, 'দি শ্যাডো ইকোনমি : অ্যান ইন্টারন্যাশনাল সার্ভে'। এই গবেষণা অনুযায়ী, আমেরিকার কালো অর্থনীতি তার জিডিপির ৬ দশমিক ৭ থেকে ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এসব ভিন্নধর্মী হিসাবের গড় নিলে দেখা যায়, আমেরিকার কালো অর্থনীতি তার জিডিপির ১৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় এক হাজার ৯ শত বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। যা বাংলাদেশের জিডিপির ১৯ গুণ। কারণ ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের জিডিপি ১০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
কালো অর্থনীতির সঠিক ও সরাসরি পরিমাপের কোনো ব্যবস্থা নেই। বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা পরোক্ষভাবে কালো অর্থনীতির পরিমাপ করে থাকেন। একটি সহজ ও পরোক্ষ পদ্ধতি হলো, আইআরএস প্রদত্ত আয়ের হিসাব এবং ফেডারেল কমার্স ডিপার্টমেন্টের সংগ্রহ করা আয়ের হিসাবের ফারাক। ২০০৩ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আমেরিকায় এই ফারাক এক হাজার ৫০ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের ২১টি দেশ নিয়ে এক গবেষণা জরিপে দেখা যায়, কালো অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি গড়পড়তা প্রতিবছর দশমিক ৫ শতাংশ হারে। এই হিসাব মতে, এটা এখন এক হাজার চার শ বিলিয়ন ডলার।
কালো অর্থনীতি পরিমাপের আরেকটি পদ্ধতি হলো, মুদ্রা চলাচলের পরিমাণ ও গতি-প্রকৃতি। ১৯৯০ সালে আমেরিকায় মাথাপিছু মুদ্রা চলাচলের পরিমাণ ছিল এক হাজার এক শ ডলার। ২০১০ সালে এসে এটা দাঁড়িয়েছে আনুমানিক তিন হাজার ডলারে। যা কিনা আগের তুলনায় প্রায় ৩০০ শতাংশ। অথচ ওই সময়ের মধ্যে মানুষের ভোগ বা কনজাম্পশন বেড়েছে মাত্র ১০০ শতাংশ। এই দুই পরিসংখ্যানের ব্যবধান থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, কালো অর্থনীতির বাড়তি চাহিদার কারণেই মুদ্রা চলাচল বেড়েছে ২০০ শতাংশ। কারণ কালো অর্থনীতির ধারক-বাহকরা কোনোক্রমেই নগদ ছাড়া চেক কিংবা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে না। কারণ তাহলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে কোনো না কোনো সময় তারা ধরা পড়ে যেতে পারে।
কালো অর্থনীতি পরিমাপের নতুন আরেক পদ্ধতি গড়ে উঠেছে মুদ্রার কম্পোজিশনকে কেন্দ্র করে। ১৯৯০ সালে আমেরিকায় মুদ্রা চলাচলে ৫১ শতাংশ ছিল ১০০ ডলারের নোট। ২০১০ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে আনুমানিক ৮০ শতাংশে। সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন ব্যবহারে কদাচিৎ ১০০ ডলারের নোট ব্যবহার করে থাকে। মুদ্রাপ্রবাহ ও চলাচলে ১০০ ডলারের নোট ব্যবহার যখন তুলনামূলকভাবে বেড়ে যায়, তার মানে কালো অর্থনীতির বিস্তার লাভ হচ্ছে। ১৯৪৬ সাল থেকে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৫০০ ডলারের নোট ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছে। কালো অর্থনীতির বিস্তৃতি রোধ ছিল তার একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। আমেরিকার ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালে মুদ্রা সরবরাহ বাড়ে ৩১ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৩০.২ বিলিয়ন ডলার ছিল শুধু ১০০ ডলারের নোট। ওই বছর দেখা গেল, নতুন নোট বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে ৮০ শতাংশ ১০০ ডলারের নোট বিদেশে পাচার হয়ে গেল। এটা হলো কেবল কালোবাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য।
নতুন শতাব্দীর গোড়ার দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে মার্কিন ডলারের চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি। শিগগিরই ডলারের এ স্থান ইউরো দখল করে নেবে। তার একটি কারণ ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্র্রতি ৫০০ ইউরো মূল্যমানের নোট ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১০০ ডলারের নোটে মিলিয়ন ডলার পরিবহন করতে কমপক্ষে একটা ব্রিফকেস লাগে, কিন্তু ৫০০ ইউরোর নোটে সমপরিমাণ অর্থ একটা সামান্য হ্যান্ডব্যাগে করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সহজেই স্থানান্তর করা যায়। সুতরাং আন্তর্জাতিক কালোবাজারিদের কাছে ডলারের চেয়ে ইউরো হবে অনেক বেশি সমাদৃৃত এবং কাঙ্ক্ষিত। ইদানীং বিভিন্ন ধরনের আলামত দেখে মনে হয়, আমেরিকার কালো অর্থনীতি, সাদা বা আইনানুগ অর্থনীতির চেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে বেড়ে উঠছে। আইআরএস কমিশনার রবার্ট জাস্টিসের মতে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যদি গোটা আমেরিকার কালো অর্থনীতিকে আইআরএসের করের আওতায় নিয়ে আসতে পারত, তাহলে কেবল কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট ঘাটতিই দূর হতো না, বরং আমেরিকার জনগণের ঘাড়ে যুগ যুগ ধরে জমে ওঠা ১৫ হাজার কোটি ডলারের বিশাল ঋণের বোঝা এক দশকের মধ্যে সহজেই শোধ করা সম্ভব হতো।
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর,
জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
awahid@tnstate.edu

No comments

Powered by Blogger.