র‌্যাবের মামলার বিচার চলছে-লিমনের মায়ের মামলার তদন্ত শেষ হয় না

পা হারানোর ঘটনার এক বছর পার হয়েছে, এখনো বিচার পায়নি লিমন হোসেন। উল্টো র‌্যাবের করা মামলায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ঝালকাঠির এই কলেজছাত্রকে। একই সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। আগামী ১ এপ্রিল পরীক্ষা শুরু হবে।

র‌্যাবের গুলিতে লিমন হোসেন শুধু একটি পা-ই হারায়নি, একই সঙ্গে তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে শিক্ষাজীবনের একটি বছর। দরিদ্র পরিবারের সন্তান লিমন ছুটির দিনে বাড়ির কাছে ইটের ভাটায় কাজ করে, টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ চালাত। সে গত বছর পরীক্ষার্থী ছিল। কিন্তু পরীক্ষার কদিন আগে ২৩ মার্চ রাজাপুর উপেজলার সাতুরিয়া গ্রামে নিজ বাড়ির পাশে র‌্যাবের গুলিতে আহত হয়। পরে জীবন বাঁচাতে চিকিৎসকেরা তার একটি পা কেটে ফেলে।
‘ক্রসফায়ারের’ প্রচলিত গল্পের আদলে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের অভিযোগ করে লিমনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়। একটি অস্ত্র আইনে, আরেকটি সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার মামলা। লিমনের ওপর এই নিষ্ঠুরতার খবরে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠলে পুলিশ তড়িঘড়ি করে গোপনে অস্ত্র মামলায় লিমনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়ে দেয়। ফলে এখন নতুন যন্ত্রণা, প্রতি মাসে ঝালকাঠি জেলা সদরে গিয়ে আদালতে হাজিরা দেওয়া।
লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে র‌্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে যে মামলা করেছে, সে মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। ‘যারা বিনা দোষে আমাকে গুলি করল, পঙ্গু করল, সেই র‌্যাব সদস্যদের সুনির্দিষ্ট নামধাম দিয়ে মামলা করল আমার মা। এক বছরেও তাদের কাউকে গ্রেপ্তার করল না পুলিশ। এটা কেমন বিচার?’—আক্ষেপ লিমনের।
জানতে চাইলে ঝালকাঠি জেলা পুলিশ সুপার মো. মজিদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, লিমনের মামলাটি দেশের আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ মামলা। আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক সভায়ও মামলাটির অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। তিনি দাবি করেন, ‘গুরুত্ব দিয়ে এই মামলার তদন্ত চলছে। গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মামলা তদন্তে একটু বেশি সময় লাগে।’
লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম বলেন, ‘লিমনের ওপর গুলিবর্ষণকারী হিসেবে র‌্যাব-৮-এর উপসহকারী পরিচালক লুৎফর রহমানসহ ছয়জন র‌্যাব সদস্যের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছি। মামলা দেওয়ার পর আমি প্রতি মাসে এক-দুইবার দারোগা হালিম স্যারের লগে দেহা করি। হে প্রতিবারই কয়, তদন্ত চলছে। কিন্তু এক বছরেও কোনো তদন্ত রিপোর্ট দেয় নাই।’
রাজাপুর থানার উপপরিদর্শক তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল হালিম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, লিমনের মায়ের করা মামলাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, তাই তদন্তে একটু সময় লাগছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, মামলার আসামিরা র‌্যাবেই কর্মরত আছেন। তাঁদের মধ্যে উপসহকারী পরিচালক মো. লুৎফর রহমানকে সমপ্রতি বরিশাল থেকে সিলেট র‌্যাবে বদলি করা হয়েছে।
লিমনের অভিযোগ, বাড়ির পাশের মাঠ থেকে গরু আনতে গেলে স্থানীয় সন্ত্রাসী মোরশেদ জমাদ্দারের সহযোগী দাবি করে র‌্যাবের সদস্যরা তার পায়ে গুলি করে। পরে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ও সংস্থার আর্থিক সহায়তায় লিমনের চিকিৎসা হয় বরিশাল ও ঢাকার একাধিক হাসপাতালে।
ছয় মাস চিকিৎসার পর কৃত্রিম পা নিয়ে লিমন গত বছরের ১৩ অক্টোবর বাড়ি ফেরে। লেখাপড়া শুরু করে। এখন তার একটাই চিন্তা, পরীক্ষায় ভালো ফল করা। তার মতে, ‘আমি তো আর দশজনের মতো চলাফেরা করতে পারব না কখনো। ভালো ফল না করলে, উচ্চশিক্ষা না থাকলে কে আমাকে চাকরি দেবে।’
বাড়ি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে কাউখালী উপজেলার কাঁঠালিয়া পিজিএস বহুমুখী স্কুল অ্যান্ড কারিগরি কলেজ থেকে সে পরীক্ষা দিচ্ছে। এত দূরে নকল পায়ে যাতায়াতের ধকল সইতে না পেরে মানুষের সহায়তায় কাউখালীতে ভাড়া ঘরে থেকেই পড়ছে সে।
লিমন নিয়ে যা হলো: গত বছরের ৬ এপ্রিল প্রথম আলোতে ‘চরম নিষ্ঠুরতা’ শিরোনামে লিমন নিয়ে প্রথম খবর ছাপা হয়। এরপর অন্যান্য সংবাদমাধ্যমেও লিমনের খবর প্রকাশিত হয়। ঘটনাটি মানবিকবোধসম্পন্ন সব মানুষকে ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়। এরপর লিমনকে সন্ত্রাসী প্রমাণের জন্য নানা তৎপরতা চলে।
এরপর গত বছরের ১৯ মে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক বাছাই করা কিছু সাংবাদিককে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ডেকে লিমনের ঘটনা নিয়ে কথা বলেন। প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা বলেন, লিমন সন্ত্রাসী বাহিনীর সঙ্গে জড়িত। এমনকি তার বাবাও সন্ত্রাসী মোরশেদ জমাদ্দারের বাহিনীর সঙ্গে জড়িত।
এরপর ২২ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘উপদেষ্টার (তারিক আহমেদ সিদ্দিক) এই বক্তব্যকে সম্মানের সঙ্গে দেখা উচিত এবং তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সরকারের বক্তব্য বলেই গণ্য করা উচিত।’
এরপর ২৩ মে সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন ডেকে লিমন ও তার বাবার পাশাপাশি তার মা ও কলেজপড়ুয়া বোনকেও সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দেয় র‌্যাব।

No comments

Powered by Blogger.