চারদিক-কিশোরগঞ্জে পথনাটক উৎসব by সাইফুল হক মোল্লা

নাটকে মাতল কিশোরগঞ্জ। বহুদিন পর একসঙ্গে বেশ কটি পথনাটক দেখার সুযোগ হলো। ‘নাটক হবে রাজপথে, জীবনযুদ্ধ একই সাথে’ স্লোগানে কিশোরগঞ্জ পথনাটক উৎসব শেষ হয়েছে ১২ মে। তিন দিনে নয়টি নাটক উপস্থাপন করে নাট্যকার ও অভিনয়শিল্পীরা দর্শকদের বোঝাতে পেরেছেন, নাটক হলো জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।

পথনাটক উৎসবে প্রতিদিন ছিল অসংখ্য দর্শকের উপস্থিতি। উপস্থাপিত নাটকগুলোয় মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, অনিয়ম, দুর্নীতি, ইভ টিজিং, বাল্যবিবাহ, নারীদের অভিনব কায়দায় নির্যাতন, গ্রাম্য মাতব্বর ও টাউটদের দৌরাত্ম্যসহ সমাজের নানা অসংলগ্নতার চিত্র ফুটে উঠেছে। পাশাপাশি সচেতন আবালবৃদ্ধবণিতার প্রতিবাদী কণ্ঠ ও তীব্র প্রতিবাদের মুখে যুদ্ধাপরাধীসহ সন্ত্রাসী ও অপরাধীরা বাধ্য হয়েছে আত্মসমর্পণ করতে। নাটকগুলোয় তুলে ধরা হয়েছে, এখনো দেশের সাধারণ মানুষের অধিকাংশ ভালো হলেও কতিপয় অপরাধীর কাছে সেই ভালো মানুষগুলো জিম্মি। কিন্তু এই ভালো মানুষগুলো জেগে উঠলে অপরাধীরা চিরতরে বিদায় নেয়।
১০ মে তিনটি নাটক উপস্থাপিত হয়। গভীর হাওরের ইটনা উপজেলার নবদিগন্ত থিয়েটার শ্যামল ছায়া নাটকটি প্রদর্শন করে। নাটকটিতে মূলত শ্যামল বাংলার একটি গ্রামে মাতব্বর ও তার ছেলের দাপট ও সন্ত্রাসের চিত্র ফুটে উঠেছে। পরে গ্রামবাসীর সম্মিলিত প্রতিবাদ ও বাধার মুখে তাদের কর্মকাণ্ড পণ্ড হয়ে যায়। চর্যাপদ নাট্যগোষ্ঠীর জাল নাটকে নারীদের অভিনব কায়দায় নানা ধরনের নির্যাতন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মানবাধিকার নাট্যগোষ্ঠীর অন্ধের দ্বন্দ্ব নাটকটিতে সমাজের নানা অসংলগ্নতার চিত্র ফুটে ওঠে এবং এসব থেকে বেরিয়ে আসার কৌশলও দেখানো হয়।
১১ মে ভৈরব নিবেদিতা নাট্যাঙ্গন উপস্থাপন করে কাজী নজরুল ইসলামের ‘খালিদ’ কবিতা অবলম্বনে রচিত নাটক ছক্কু পাগলা। নাটকে ফতোয়াবাজদের দৌরাত্ম্য এবং ফতোয়ার মাধ্যমে নারীদের নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র অভিনয়শিল্পীরা সফলভাবে দর্শকদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হন। ফতোয়া নাটকটি প্রদর্শন করে মানবাধিকার নাট্য পরিষদ (মহিনন্দ ইউনিয়ন)। বহুব্রীহি নাট্য পরিষদ ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাঁচাল নাটকটি প্রদর্শন করে। নাটকটিতে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও যুদ্ধাপরাধীদের নানা কাহিনি বর্ণনা করা হয়।
১২ মে চন্দ্রাবতী থিয়েটার ত্রাস নাটকটি উপস্থাপন করে। এতে ধনী গ্রাম্য মাতব্বরের বখাটে ছেলের অপরাধের হাত কতটা লম্বা হতে পারে, তা ফুটে উঠেছে। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে শুধু অর্থের দাপটে কীভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সেটিও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
প্রচীত সাংস্কৃতিক পরিবার প্রদর্শন করে এখনই সময়। নাটকটিতে পুলিশ, চিকিৎসক, ভূমি, রাজস্ব বিভাগসহ বিভিন্ন পেশার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কীভাবে দুর্নীতি করে, তার ভয়ংকর চিত্র দেখে দর্শকের সারিতেও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
একতা নাট্যগোষ্ঠীর রয়েল বেঙ্গল টাইগার নাটকটির স্মরণীয় উপস্থাপনা দর্শক অনেক দিন মনে রাখবে। নাটকে প্রতিটি কর্মকাণ্ডে ছিল রসের খোরাক। তবে প্রতিটি সংলাপ দর্শকের হূদয় স্পর্শ করেছে। রাজাকার-আলবদর ও যুদ্ধাপরাধীরা সরকারি ছত্রচ্ছায়ায় বিভিন্ন কৌশলে কীভাবে দেশটাকে তছনছ করে দিন দিন নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছে, তার এক অনবদ্য উপস্থাপনা ছিল নাটকটিতে।
গুরুদয়াল সরকারি কলেজের স্মৃতিস্তম্ভে ১০ মে পথনাটক উৎসবের উদ্বোধন করেন পৌর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ শরীফ সাদী। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন গুরুদয়াল সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ মো. ফজলুল হক, নাট্যকার মানস কর প্রমুখ।
স্থানীয় নাট্যকার ও অভিনেতাদের সহযোগিতায় বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর যৌথ আয়োজনে পথনাটক উৎসবে কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার নয়টি দল অংশ নেয়।
গুরুদয়াল সরকারি কলেজের ছাত্র মোবারক বলেন, ‘পথনাটক উৎসবটি শিক্ষার্থীদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। প্রতিটি নাটক শিক্ষার্থী-দর্শকেরা মনোযোগ দিয়ে দেখেছে। নাটকটি ছাত্রছাত্রীদের চেতনাকে নাড়া দিয়ে শাণিত করেছে বলে আমার বিশ্বাস।’
স্নাতকোত্তর শ্রেণীর শিক্ষার্থী সাদিয়া তাবাসসুম বলেন, সব কটি নাটকে যেসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, সেসবের সমাধান করতে হলে জনগণকে সচেতন করতে হবে। রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছা থাকলে সেগুলোর সমাধান করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারণ, নাটকগুলোয় দেখানো হয়েছে, জনগণকে সচেতন ও জাগানোর দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের। সে জন্য যোগ্য ও সৎ রাজনীতিবিদের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
পথনাটক উৎসবকে ঘিরে প্রতিদিন বিভিন্ন বয়সের বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষের আগমন এবং দর্শকসারিতে সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করেছে। দর্শকসারিতে প্রতিদিন অসংখ্য (টোকাই) সুবিধাবঞ্চিত শিশুরও আগমন ঘটে। টোকাই সোহেল মিয়া বলে ওঠে, ‘নাটক দেইখ্যা বুঝলাম, বড়লোকেরা বালা কাম করে না। আবার হগলে মিল্লা বাধা দিলে হেরা পালাইয়্যা যায়।’
নাট্যকার মানস কর জানান, নাটকে সমাজের বৈষম্য, অসংলগ্নতা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, নোংরা রাজনীতির মুখোশ উন্মোচনসহ নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আবদুল গনি জানান, নাটক হলো সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। পথনাটক উৎসবটি প্রশংসার দাবি রাখে। এখানে উপস্থাপিত প্রতিটি নাটকই সমাজের নানা সমস্যা, পেশিশক্তির অবৈধ ব্যবহার তুলে ধরাসহ তরুণ সমাজকে ভবিষ্যতের হাল ধরার কাজটি বুঝিয়ে দিয়েছে।
সাইফুল হক মোল্লা

No comments

Powered by Blogger.