যুক্তি তর্ক গল্প-সবার অংশগ্রহণের সুযোগ চাই by আবুল মোমেন

একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে দেশ স্বাধীন করা সম্ভব নয়। স্বাধীনতা আসে অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাস ও আন্দোলন-সংগ্রামের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ কেবল আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধ থাকলে তাতে বিজয় অর্জিত হতো না। দলমত-নির্বিশেষে এ যুদ্ধে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই ছিল সাফল্যের মূলে।

বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নেতা থেকে জাতীয় নেতায় উন্নীত হয়েছিলেন ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময় থেকে। তাই তাঁকে মানুষ বঙ্গবন্ধু অভিধায় আখ্যায়িত করেছে, স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা সম্বোধন করেছে সানন্দে—সেটা সত্য এবং সেটাই স্বাভাবিক।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যেমন একটু আকস্মিকভাবে শুরু হয়েছিল, তেমনি এতে জনগণের অংশগ্রহণ ঘটেছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে। যুদ্ধের শুরুটা সুপরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিত ছিল না। বেশির ভাগ মানুষ নিজ নিজ ইচ্ছা ও প্রাপ্ত সুযোগ অনুযায়ী নিজের ভূমিকা পালন করে গেছে। এটি ছিল এ যুদ্ধের একটি ইতিবাচক দিক।
কিন্তু যেখানেই পরিকল্পিতভাবে কিছু করার প্রয়োজন ছিল, করা হয়েছিল, সেখানেই লক্ষ করা যায় নানা রকম উপদলীয় কোন্দল ও নেতিবাচক ঘটনা ঘটেছিল। প্রবাসী সরকারে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে বিশেষভাবে নির্ভর করতে হয়েছিল ভারতীয় সহায়ক শক্তির ওপর। কারণ, তাঁর স্বদলীয় নেতারা নানা ভাগে বিভক্ত ও অনেকে বিভ্রান্ত ছিলেন। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তৈরি মুজিববাহিনী, বিএলএফ অনেক সাহসী যুদ্ধ করেছে যেমন, তেমনি আবার অনেক সময় বামপন্থী তরুণদের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যুদ্ধকালেই বিভক্তির সূচনা করেছে। দিন যত গড়িয়েছে, ততই ওপরের দিকে লোক-দেখানো বা কাগুজে সর্বদলীয় উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠিত হলেও মধ্য ও মাঠপর্যায়ে দলীয়ভাবে বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক শক্তি ও ক্ষমতা সংহত করার মানসিকতারও প্রকাশ ঘটেছে। স্বাধীনতার প্রাক্কালে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিকদের মধ্যে দলাদলির মনোভাব সক্রিয় ছিল। এর পেছনে অবশ্যই স্বাধীনতা-পরবর্তী বাস্তবতায় ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত লাভের বিষয়টিই ছিল মূল বিবেচ্য। অর্থাৎ, যখন সাধারণ যোদ্ধারা জানবাজি রেখে রণাঙ্গনে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন, প্রাণ দিচ্ছিলেন অকাতরে, তখনো অনেকেই অবস্থার ও পরিবর্তনের ফায়দার দিকে নজর রেখেছিলেন।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সত্তরের নির্বাচনের অঙ্গীকারকে—সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পূরণ—অগ্রাধিকার দিলেন একাত্তরের অভিজ্ঞতা ও যুদ্ধ-পরবর্তী দেশের চাহিদার বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে। ফলে তখনো জনমনে জাতীয় দায়িত্ব পালনের যে মহৎ বোধ কার্যকর ছিল, তা নেতৃত্ব থেকে মূল্যায়িত হলো না, বরং উপেক্ষিত হলো। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভর করলেন, আওয়ামী লীগের ছোট-মাঝারি নেতারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের নেতা হিসেবে সর্বত্র নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও সেই সুবাদে ভোগদখলের সংস্কৃতি চালু করলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় অংশও এই স্রোতে গা ভাসালেন। ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী জাতি বিভক্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ল। শেখ সাহেব তাঁর জাদুকরি নেতৃত্বের ক্যারিশমা দিয়ে সংকট উত্তরণের অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না।
এর কারণ হলো, বাংলাদেশের সমস্যাগুলো মৌলিক ও ব্যাপক। ফলে দারিদ্র্য, জনসংখ্যা, অশিক্ষা, অপুষ্টি, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারে এবং একটি দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণে ক্ষতিগ্রস্ত, প্রায় স্থবির আধাসন্ত সমাজের বৈষম্য-নিপীড়ন-অস্বচ্ছতাসহ পশ্চাৎপদতার সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত থাকে এ ধরনের সমাজ। তার এই পশ্চাৎপদতা ও অনুন্নয়নের বৃত্ত ভাঙার জন্য প্রয়োজন হয় গণজাগরণ, আলোকন—যার প্রভাবে সমাজই পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। বস্তুতপক্ষে, ভাষা আন্দোলন থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটেছিল, তারই রেশ ধরে ষাটের দশকের শেষে গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে অভূতপূর্ব বিজয় এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও তাতে বিজয় অর্জিত হয়। স্বাধীনতার মাধ্যমে পরাধীনতা ঘুচল বটে, কিন্তু দেশ ও সরকার পরিবর্তনকে গৌণ করে এর সুফল সমগ্র মানুষের কল্যাণে ছড়িয়ে দেওয়া যায় কীভাবে, তা আমরা বুঝিনি।
পঁচাত্তরের পর দেশ থমকে গিয়েছিল। এটা আবার কাটতে শুরু করে ’৭৯-তে নির্বাচন হওয়া ও সংসদ গঠিত হওয়ার পর থেকে। তবে এবারও পাকিস্তান পর্বের মতোই, সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে প্রতিবাদের জোয়ার শুরু হয়। মূল লক্ষ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ কায়েম। এটি স্লোগান আকারে লক্ষ্য হিসেবে উচ্চারিত হলো বটে, কিন্তু ধারাবাহিকভাবে সাংস্কৃতিক প্রতিবাদী কার্যক্রমের বাইরে মূল লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো তখন সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি, সম্ভব ছিল না। যুগোপযোগী শিক্ষা, বেকারত্ব মোচনের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য, খাদ্য ও পানি, আবাসন ও নাগরিক সুবিধা এবং সেবা খাত ইত্যাদি কাজগুলো বাস্তবায়নে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। কিন্তু বিশাল জনসংখ্যার দেশে এ কাজ একা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়, এমনকি কেবল কর্মসূচি ও প্রকল্প প্রণয়নের মাধ্যমেও বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে জাতীয় উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে তা বাস্তবেই ঘটানো দরকার। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিষয়টা এভাবে দেখতে রাজি নন।
২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে জনগণের আকাঙ্ক্ষাগুলো পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল। এবং তা এতই স্পষ্ট ও তীব্র ছিল যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের তেমন অবদান ছাড়াই একটা নীরব গণসচেতনতা ও গণসক্রিয়তা নির্বাচনেই ঘটে গিয়েছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয় এরই পরিণতি। তরুণ, নারী ও সামরিক বাহিনীও আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রেখেছে। মানুষ চেয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচার, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, নারী নির্যাতন বন্ধে ব্যবস্থা, সাম্প্রদায়িক ও জাতিপীড়নমুক্ত মানবিক পরিবেশ, যুগোপযোগী শিক্ষা, দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ ও সহনীয় মাত্রা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শান্তি ও শৃঙ্খলাপূর্ণ নাগরিক জীবন। তারা চেয়েছে সহনীয় মর্যাদাপূর্ণ জীবন। এ কাজ একা সরকারের পক্ষে কিংবা আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্পাদন করা সম্ভব নয়। এটি জাতীয়ভাবে উদ্দীপনা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমেই কেবল অর্জন করা সম্ভব।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আমাদের রাজনীতিবিদেরা গতানুগতিক পথ ও চিন্তার বৃত্ত থেকে বেরোতে পারছেন না। তাঁরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে ক্ষমতা ভোগ ও ব্যবহারে বিশ্বাসী। ফলে বিজয়ী দলের নেতা-কর্মীরা সমাজে একটি ক্ষমতাশালী শ্রেণী তৈরি করে, যারা কোনো না কোনোভাবে নিজেদের জন্য আইন-নিয়মের ঊর্ধ্বে থাকার ব্যবস্থা করে ফেলে। এরই উপজাত হিসেবে তৈরি হয় ক্ষমতাকে দলীয় বৃত্তে কেন্দ্রীভূত, কবজা ও একচেটিয়া করে নেওয়ার প্রবণতা। যাঁরা সরকারে নেতৃত্ব দেন, তাঁরা মুখরক্ষা, লজ্জা ঢাকা বা সমালোচনার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কিছু কথা বলেন, দু-একটা ব্যবস্থাও নেন। কিন্তু মূল প্রবণতা বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো চলতে থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না সরকারের ওপর মানুষের আস্থা টলে যায়। এটি খানিকটা জমিদার বা বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলের মতো অবস্থা। বর্তমান ছাত্রলীগ-যুবলীগ বা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন উপদল, নেতাকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর অবস্থা তো তা-ই।
সে সরকারই দেশে সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে এবং মানুষের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন করতে পারবে, যেটি দলমত-নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য কাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেবে। কিন্তু সরকার যদি সব ধরনের কর্মসংস্থানে কেবল দলীয় আনুগত্যের বিচারকেই মাপকাঠি ধরে, তাহলে ক্ষতি হবে তিন ধরনের—প্রথমত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যোগ্য প্রার্থী আসবে না; দ্বিতীয়ত, দলীয় আনুগত্যের নিশ্চয়তা ও সুরক্ষা থাকায় এরা কর্মশক্তি হিসেবে ভালো হবে না এবং তৃতীয়ত, জনমতের যে ঐক্যের ভাবাদর্শে ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল, তার বিনষ্টি ত্বরান্বিত হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য, আওয়ামী লীগ এই পথেই চলছে।
আমি বলব, এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি। সময়ের ও দেশের চাহিদা অনুধাবন করে আওয়ামী লীগের উচিত হবে দ্রুত কাজের ধারায় পরিবর্তন আনা। মনে রাখতে হবে, একাত্তরের মতোই অল্প কিছু যুদ্ধাপরাধী, জঙ্গিবাদী এবং অগ্রগতি ও সমাজবিরোধী শক্তি আছে, বাকি সব মানুষ, দলমত-নির্বিশেষে, দেশ ও সমাজের কল্যাণে অবদান রাখতে উৎসাহী। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে যথাযথ কাজের পরিকল্পনা ও কাজের পরিবেশ তৈরি করাই হচ্ছে বাংলাদেশে আজকের ক্ষমতাসীন দলের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অতীতে কোনো সরকার পারেনি, বরং বলা যায়, সব সরকারই জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছিল। আজও কান পাতলে জনগণের সরব ও নীরব ভাষ্য কী, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তারা সরকারের দিকে ব্যর্থতার আঙুল তুলতে শুরু করেছে। ফলে নষ্ট করার মতো সময় আর নেই।
দলের, বিশেষত ছাত্রলীগ-যুবলীগের মোহ বাদ দেওয়ার মতো ঘটনা তো প্রতিদিনই ঘটে চলেছে। এই অন্ধ মোহ কাটাতে দেরি করলে দেশ ও দল উভয়েরই ক্ষতি হবে। সবার জন্য সুশিক্ষা, প্রশাসন ও জনজীবন থেকে দুর্নীতি অবসানের জোরালো ফলপ্রসূ কার্যক্রম, শান্তিশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটিয়ে স্বস্তিপূর্ণ নাগরিক জীবন, কর্মসংস্থান ও তুলনামূলকভাবে উন্নত জীবনসহ গ্রামোন্নয়ন, নগরে ও গ্রামে সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা—এ সময়ে অন্তত এ কাজগুলো নাগরিকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নের এক বিশাল কর্মযজ্ঞ হিসেবে শুরু করা যায়। এটা বস্তুত একাত্তরের চেতনা ও প্রেরণা থেকে রীতিমতো মুক্তির লড়াই হিসেবেই চালাতে হবে। সত্যিই তো অশিক্ষা, দুর্নীতি, অপুষ্টি, কুসংস্কার, বৈষম্য থেকে মুক্তি না পেলে স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যায়। তাই এসব ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই তো মুক্তিযুদ্ধই বটে। সরকার যোগাযোগব্যবস্থা, সেবা খাত, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, গঠনমূলক আইন সভা, দক্ষ সৎ জনপ্রশাসন, শিল্পায়ন, গবেষণা ইত্যাদিতে সরাসরি কাজ করবে বা বিনিয়োগ করবে।
জনগণ প্রকৃত মুক্তির যে লড়াই চালাবে, তাতে অর্থ, লজিস্টিক সহায়তা ও কাজের পথের অন্যান্য বাধা দূর করে সরকার সব সময় পাশে থাকবে। এটিই জনগণের ও কল্যাণমুখী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা।
শেখ হাসিনা কি সে প্রত্যাশা পূরণ করবেন না?
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.