চারদিক-‘দুর্জয় বাংলা’র সৈনিক by সুমনকুমার দাশ

১৯৭১ সাল। ঘটনাস্থল ভারতের শিলচর। শরণার্থী শিবির আর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ঘুরে ঘুরে ২১ বছরের এক তরুণ মুক্তিযুদ্ধের নানামুখী সংবাদ খুঁজে বের করতেন। সেসব সংবাদ প্রতিবেদন আকারে তৈরি করে নিজের সম্পাদিত দুর্জয় বাংলা পত্রিকায় ছাপাতেন। এরপর ওই পত্রিকা শিলচরের বিভিন্ন বাসা-বাড়ি থেকে শুরু করে শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে বিক্রি করে পরবর্তী সংখ্যার জন্য টাকা সংগ্রহ করতেন।

১৯৭১ সালের জুলাই মাসে পত্রিকাটির আত্মপ্রকাশ, বিজয় শেষে ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছিল পত্রিকাটির সর্বশেষ সংখ্যা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়া থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রাম-দুর্যোগে এখনো সমানতালে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন ওই সময়ের সেই তরুণ। সেদিনের ২১ বছরের তরুণ, যাঁর জন্ম সিলেটের জাফলং চা-বাগানে ১৯৫০ সালের ৫ ডিসেম্বর, এখন ৬১ বছরের বয়োবৃদ্ধ।
তিনি তুষার কর। মুক্তিযুদ্ধে কলমসৈনিকের ভূমিকা পালন করলেও আজ পর্যন্ত কোনো সরকারি-বেসরকারি স্বীকৃতি পাননি। বরং চরম অর্থকষ্টে দুঃসময়ে কাটছে তাঁর শেষ বয়সের দিনগুলো। বর্তমানে সিলেট নগরের রামের দিঘিরপার এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে স্ত্রী চিত্রলেখা কর ও এক মেয়ে প্রজ্ঞা পারমিতাকে নিয়ে বসবাস করছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোর কাহিনি শোনাতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন তুষার কর। তাঁর মুখেই শুনি সে সময়ের কথা: ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, গ্রেপ্তার এড়াতে সিলেটের সীমান্তবর্তী জাফলং এলাকায় চলে যাই। এক সময় সীমান্ত অতিক্রম করে ডাউকি পাড়ি দিয়ে শিলং পুলিশবাজার যাই। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য সংগঠকের সঙ্গে দেখা হয়। মে মাসে সিলেটের কিছু শিল্পী-সাহিত্যিক শিলচর গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে গান গেয়েছেন। তখন তাঁদের সঙ্গ দিয়েছি।
‘মুক্তিযুদ্ধের সময় শিলচর থেকে সাপ্তাহিক অরুণোদয় নামে একটি পত্রিকা বের হতো। সন্ধ্যার পর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকেরা সেখানে বসতেন। আমিও অন্য সবার সঙ্গে সেখানে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র, আকাশবাণী ও বিবিসির সংবাদ শুনতাম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সিলেটের বিয়ানীবাজারের আবদুল মতিন চৌধুরী (বর্তমানে প্রয়াত) সাপ্তাহিক বাংলাদেশ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। জুন মাসে তিনি ওই পত্রিকায় আমাকে রণাঙ্গন প্রতিনিধি নিয়োগ দিলেন। আমি তখন বিভিন্ন শরণার্থী শিবির, ক্যাম্প ও রণাঙ্গন ঘুরে “রণাঙ্গনের খবর” শিরোনামে লিখতাম।
‘বাংলাদেশ পত্রিকায় লেখার সুবাদেই নিজেই একটি পত্রিকা বের করার ইচ্ছে জাগে। এরই অংশ হিসেবে দুর্জয় বাংলা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিই। এক অনতিতরুণের উৎসাহ দেখে শিলচরের এক প্রেস মালিক বাকিতে পত্রিকার প্রথম সংখ্যা ছেপে দিলেন। এরপর পথেঘাটে, রাস্তায়, মুক্তিযোদ্ধা শিবির, ক্যাম্পে, স্থানীয় হাটবাজারে ঘুরে ঘুরে হকারের মতো পত্রিকা বিক্রি থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন ও খবর সংগ্রহ করতাম। আমিই সম্পাদক, আমিই হকার, আমিই বিজ্ঞাপন ব্যবস্থাপক। সর্বমোট সাত-আট সংখ্যা বের হয়েছিল। পত্রিকাটির সর্বশেষ সংখ্যা বের হয় ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১। সেই সংখ্যার প্রধান শিরোনাম ছিল : “বাংলার দাবি, বাঙালির দাবি, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই”।
‘১৫ ডিসেম্বর রাতে যখন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সংবাদ পরিক্রমা’য় দেশ স্বাধীনের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, তখন সে কী উচ্ছ্বাস! আমরা ভারত-বাংলাদেশের মানুষ মিলে শিলচর শহরে বিশাল আনন্দ মিছিল বের করি। বাংলাদেশের হাজারো শরণার্থী সেই মিছিলে অংশ নিয়েছিল। এখনো সেই দৃশ্য চোখে ভাসলে শরীর শিহরিত হয়।’
যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে আসেন তুষার কর। মদনমোহন কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন। তবে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ডিগ্রিতে ভর্তি হলেও তিনি আর পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। কারণ, অভাব-অনটনের সংসারে পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে সংসারের হাল ধরতে তিনি ব্যাংকে চাকরি নেন। চাকরির পাশাপাশি জড়িত ছিলেন উদীচী, বাংলাদেশ রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, খেলাঘরসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে। সেই সুবাদেই ঘনিষ্ঠতা হয় প্রয়াত কবি শামসুর রাহমান, সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন, মফিদুল হক, মহাদেব সাহা, নারীনেত্রী মালেকা বেগমসহ অনেকের সঙ্গে। শামসুর রাহমান তুষার করের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে অনেক চিঠি তাঁকে লিখেছেন, ২০০৩ সালে ‘কৃষ্ণপক্ষে পূর্ণিমার পথ’ নামে একটি কবিতাও তাঁকে উৎসর্গ করেছিলেন। শামসুর রাহমানের আত্মজীবনী কালের ধুলায় লেখা গ্রন্থের বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে কবি তুষার করের স্মৃতিচারণা।
তুষার কর জানালেন, তাঁর সংগ্রহে থাকা মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য উপকরণ ঢাকার সেগুনবাগিচায় অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করতে চান। তিনি বলেন, ‘আমার সংগ্রহে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অসংখ্য দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকা ও দলিলাদি ছিল। ১৯৭৬ সালের দিকে কবি হাসান হাফিজুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার জন্য আমার কাছ থেকে এক ট্রাঙ্ক পত্রপত্রিকা নিয়ে যান। এখনো বেশ কিছু পত্রপত্রিকা আমার হাতে রয়েছে। আমার ইচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর যদি সেগুলো গ্রহণ করে তাহলে তাদের কাছে সেগুলো হস্তান্তর করব।’
তুষার কর এখন কিডনি ব্যাধি নিয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী। সরকারি কিংবা বেসরকারি পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে কলমসৈনিকের ভূমিকা পালনের জন্য তাঁর কোনো স্বীকৃতি-পুরস্কার নেই। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়তে তুষার কর এখনো আদর্শের সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধীদের বিচার দেখে মরতে চাই, এ ছাড়া আর কিছু চাই না।’
 সুমনকুমার দাশ

No comments

Powered by Blogger.