সংবিধান-পুনঃ পুনর্মুদ্রণের অপেক্ষায় by শাহ্দীন মালিক

সংবিধান পুনর্মুদ্রণের ধুন্ধুমার শুরু হয়েছিল মাস সাত-আট আগে। পাঠকদের নিশ্চয় মনে পড়বে, টেলিভিশনের মাইক সামনে ধরে ক্যামেরা মুখের দিকে তাক করলে বক্তব্য একটাই। পঞ্চম সংশোধনী রায়ের পর এখন সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করা লাগবে। রায় অনুযায়ী সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করলেই সব সমস্যার নিরসন হবে।

সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়ে দিয়েছেন। অতএব সবার করণীয় একটা কাজ পুনর্মুদ্রণ।
অধমের মুখমণ্ডলের দিকে কোনো টেলিভিশন ক্যামেরা যে তাক করেনি, সে কথা হলফ করে বলতে পারব না। তবে অকপটে স্বীকার করছি, পুনর্মুদ্রণসংক্রান্ত সংবাদকর্মীদের প্রশ্নের সম্মুখীন হলেই ভয়ে গলা শুকিয়ে যেত। মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোত না।
নিজের ভয় নিজেই জয় করার জন্য লিখতে বসলাম গোটা তিনেকবার। লেখাও হয়েছিল। কিন্তু ভয় জয় হয়নি। লেখাগুলো পত্রিকায় পাঠানো হয়নি।
বলতেও পারি না, লিখতেও পারি না। এমন অবস্থাকেই পশ্চিমা সংস্কৃতিতে বোধ হয় বলে ‘মিডলাইফ ক্রাইসিস।’
লেখায় কিছু কথা বারবার ব্যবহার করার দোষ কাটাতে পারছি না। হাতি-ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল—এই পরিচিত প্রবাদসম কথাটা আগেও ব্যবহার আমরা করেছি। এবার নিজকেই মশা মনে হয়েছিল, তাই ক্যামেরা দেখলেই গলা শুকিয়ে যেত, লেখা প্রথম আলোর সম্পাদকীয় দপ্তরে পাঠানোর সাহস সঞ্চয় করতে পারা হয়নি।
ব্যাপারটা খোলাসা করি। শ্রদ্ধাভাজন অভিজ্ঞ আইনজীবী থেকে আইনমন্ত্রী। তিনি বহু দিন ধরেই বলতে থাকলেন এখন করণীয় একটাই, অর্থাৎ সংবিধান পুনর্মুদ্রণ। মনে হচ্ছিল ভাবখানা এই যে, আদালত তাঁর কাজ করেছেন, অর্থাৎ পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে রায় দিয়েছেন। ফলে মন্ত্রণালয়ের শোভা পায় একটা কাজই। রায় অনুযায়ী সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করা। টেলিভিশনের ক্যামেরা দেখলেই আইনমন্ত্রীর কথা একটাই—পুনর্মুদ্রণ।
কিছু দিনের মধ্যেই লক্ষ করলাম, দলে দলে সবাই পুনর্মুদ্রণ নৌকায় উঠে গেলেন। চারদিকে রব—বাণী একটাই—সংবিধান পুনর্মুদ্রণ, সংবিধান পুনর্মুদ্রণ।
সবাই বলে পুনর্মুদ্রণ, তখন এই অধম কেমনে বলে ধারণাটাই সম্পূর্ণ ভুল। তদুপরি অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ে ১৯৮৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ যেটা সংশোধন করে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সংসদ শহরে শহরে হাইকোর্ট বসার ব্যবস্থা করেছিল, সেই বহুবিধ হাইকোর্ট-সংক্রান্ত সংশোধনী বাতিল করে বলা হয় একটা মাত্র হাইকোর্ট-সংক্রান্ত পুরোনো ১০০ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবিত হবে এবং সে অনুযায়ী পুরোনো ১০০ অনুচ্ছেদসহ সংসদের মতামত ছাড়াই সংবিধান পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল, অর্থাৎ সংবিধান সংশোধনী বাতিল করা আগের অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ের ফলে সংবিধান পুনর্মুদ্রণের যেহেতু একটা নজির প্রতিষ্ঠিত ছিল, সেই নজিরের বরাত দিয়ে সবাই পুনর্মুদ্রণ পুনর্মুদ্রণ নৌকায় ওঠার জন্য হুটোপুটি লাগিয়ে দিল।
গলা শুকিয়ে কাঠ। কেমনে বলি, অষ্টম সংশোধনী রায়ের মাধ্যমে সংসদের অনুমোদন ছাড়া পুরোনো ১০০ অনুচ্ছেদ পুনর্মুদ্রণ করা ছিল একটা ভুল সিদ্ধান্ত। একটা সিদ্ধান্ত ভুল হতেই পারে, কিন্তু একটা ভুল সিদ্ধান্তের নজির টেনে বারবার একই ভুল করা নিশ্চয়ই বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
আশির দশকের অন্তত গোটা তিনেক রায়ে আপিল বিভাগ বলেছিলেন, মার্শাল লর স্থান সংবিধানের ঊর্ধ্বে। এখন ওই নজিরগুলো দেখিয়ে যদি বলার চেষ্টা করি যে, মার্শাল লই আসল ল, তাহলে কেউ কি আমার পিঠের চামড়া আস্ত রাখবে। মার্শাল ল-সংক্রান্ত এরূপ ফতোয়া দেওয়ার জন্য আমার যদি ১০০টা বেত্রাঘাতের শাস্তি ঘোষণা করা হয়, তাহলে সেই বেত্রাঘাত থেকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসবে না।
অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট ভুল ব্যাখ্যা দিতেই পারেন। কিন্তু একটা ব্যাখ্যা যে ভুল হতে পারে সেটাই স্বীকার করা উত্তম। লিমনকে গুলি করে, ভুল করে সেটা স্বীকার না করে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা দায়ের করা যেমন বুদ্ধিমানের কাজ নয়, তেমনি অষ্টম সংশোধনী রায়ের নজির ধরে একই ভুল এখন আমরা কতবার করব।

২.
পঞ্চম সংশোধনী রায়ের পর সংবিধান সেই রায়ের আলোকে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। অনেক কষ্টে বহু দিন পর অধম বিধিবহির্ভূতভাবে একটা কপি অর্থাৎ পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের ফটোকপি জোগাড় করেছি। সরকারিভাবে ৫০০ কপি পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। এখন তা সবচেয়ে গোপনীয় রাষ্ট্রীয় দলিল। কারও কাছে কোনো কপি নেই।
সংবিধান-বলে একটা বই গেজেট করে অর্থাৎ সরকারিভাবে ছাপিয়ে সেটা গায়েব করা—এই নজির বিশ্বের সাংবিধানিক ইতিহাসে যদি থেকে থাকে তাহলে সেটা জানালে বাধিত হব।
সপ্তাহ খানেক আগে অর্থাৎ ১১ মে পঞ্চম সংশোধনী রায়ের রিভিউ আদেশ জারি হয়েছে। অর্থাৎ পঞ্চম সংশোধনী রায়ের লেটেস্ট সংস্করণ হয়েছে।
এখন কেন পুনর্মুদ্রণ পুনর্মুদ্রণ বাণী শুনছি না। ইতিমধ্যে অষ্টম সংশোধনী ও পঞ্চম সংশোধনী রায়ের পর পুনর্মুদ্রণের দু-দুটো নজির স্থাপিত হয়েছে। আর রিভিউ আদেশে আপিল বিভাগের আগের আদেশের বেশ কয়েকটি পরিবর্তন করা হয়েছে। অতএব এই নতুন পরিবর্তনগুলো অন্তর্ভুক্ত করে সংবিধানের আরেকটা পুনর্মুদ্রণ আবশ্যক। শুধু আবশ্যকই নয়, এটাই তো এখন আইন। ত্বরিতগতিতে পুনঃ পুনর্মুদ্রণ না হলে আইন ভঙ্গের দায়ে কাউকে তো দোষী হতেই হবে। অর্থাৎ এটা হবে দ্বিতীয় পুনর্মুদ্রণ।
মাস তিনেক আগে হাইকোর্ট সপ্তম সংশোধনী রায়ে প্রায় দুই পৃষ্ঠাব্যাপী কারণ বা যুক্তি দর্শিয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, যেহেতু ওই রায়ে সপ্তম সংশোধনী বাতিল হয়েছে, সেহেতু রায়ের প্রতিফলন ঘটাতে পুনর্মুদ্রণ আবশ্যক। এ লেখার মাঝে খবরে শুনলাম, আপিল বিভাগও সপ্তম সংশোধনী বাতিল করা হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেছেন।
অতএব সংবিধানের তৃতীয় পুনর্মুদ্রণ। চার-পাঁচ দিন আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনীও বাতিল হয়েছে বলে একটা জনরব আছে। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত রায়ের ‘আদেশ’ অংশটা পড়েছি। অকপটে স্বীকার করছি, আদেশে লাতিন-ইংরেজি মিলিয়ে কুল্যে ছয়টা বাক্য, কিছু বাক্যের মর্ম উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যা-বুদ্ধি অধমের আয়ত্তের বাইরে। তবে মোদ্দাকথা হলো, যেহেতু ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল হয়েছে, সেহেতু আবার পুনর্মুদ্রণ আবশ্যক।
সংবিধানের চতুর্থ পুনর্মুদ্রণ অচিরেই ছাপা হওয়ার একটা আইনগত বাধ্যবাধকতা আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর অর্পিত হয়েছে। অতীতের নজির, পঞ্চম সংশোধনী রায়ের পর পুনর্মুদ্রণ এবং সপ্তম সংশোধনী রায়ে হাইকোর্ট কেন পুনর্মুদ্রণ বাধ্যতামূলক সেই প্রশ্নে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সব মিলিয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ সংশোধনী না করলে আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিঃসন্দেহে আদালতের রায় উপেক্ষা অর্থাৎ আদালত অবমাননার মামলা হবে এবং পুনর্মুদ্রণ ছাড়া সংসদীয় কমিটির পক্ষে এটা বোঝা অসম্ভব যে, সংবিধানের বর্তমান অবস্থা কী। সুপ্রিম কোর্টের রায়গুলোর ফলে সংবিধান পুনর্মুদ্রিত না হলে সংসদীয় কমিটির কাজ করা অসম্ভব। অতএব কমিটির এখন দীর্ঘস্থায়ী ছুটি প্রয়োজন।
পঞ্চম সংশোধনী মামলার রিভিউ অর্ডারটার মর্ম উদ্ঘাটনও নিতান্ত দুষ্কর। সন্দেহ হচ্ছে, এই রিভিউ অর্ডারে একাদশ সংশোধনী তো বাতিল হয়েছেই, দ্বাদশ সংশোধনীর কিছু অংশও সম্ভবত বাতিল হয়েছে। ১৫ মে প্রথম আলো এ-সংক্রান্ত একটা রিপোর্টও ছাপিয়েছে প্রথম পাতায়। এখন যদি রিভিউর রিভিউ লাগে, তাহলে আশ্চর্যান্বিত হব না।
খেই হারিয়ে ফেলছি। তাহলে সংবিধানের পঞ্চম না ষষ্ঠ পুনর্মুদ্রণ লাগবে, সে হিসাব মেলাতে নিশ্চয় বিশেষভাবে অজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে আরেকটা কমিটি লাগবে।

৩.
এবার ঠিক করেছি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ল-স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের সাংবিধানিক আইনের কোর্সটি পড়াব। প্রথম ক্লাসেই দুটো ব্যাপারে আলোচনা করব। রাষ্ট্রের অঙ্গ তিনটি—নির্বাহী, সংসদ ও বিচার। প্রথম দুটো নির্বাহী বিভাগ আর সংসদ জনগণের ভোটে নির্বাচিত। তৃতীয় অঙ্গ অর্থাৎ বিচার বিভাগ, অনির্বাচিত অঙ্গ। একটা ছোট্ট ব্যতিক্রম ছাড়া গণতন্ত্রে অনির্বাচিত অঙ্গের ক্ষমতা নির্বাচিত অঙ্গের ঊর্ধ্বে হতে পারে না।
দ্বিতীয় কথা—সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে সংসদের ওপর। বিচার বিভাগ আইন প্রণয়ন করতে পারে না। বিচার বিভাগের ক্ষমতার দৌড় নির্বাহী ও বিচার বিভাগ পর্যন্ত। বিচার বিভাগের ক্ষমতার হাত সংসদ পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে না। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে বলব, সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদ বারবার, জোরে জোরে পড়তে। মুখস্থ করানোর জন্য পড়াই না। তবে এবার ১১২ অনুচ্ছেদ সবাইকে মুখস্থ করিয়ে ছাড়ব।
সংবিধানের ষষ্ঠ পুনর্মুদ্রণের অপেক্ষায় থাকব, নাকি আশা করব সরকার নিজেই এর আইনগত সমাধান খুঁজে বের করতে পারবে।
র্যাব যেভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করছে, মনে হচ্ছে, সে একই পন্থায় আমরা সংবিধান ঠিক করছি।
সংবিধান কীভাবে বুঝতে হবে, সেটা আগে বুঝতে হবে।
ড. শাহ্দীন মালিক: অধ্যাপক ও পরিচালক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি।

No comments

Powered by Blogger.