রাজধানীতে রাতে নিশিকন্যাদের আড়ালে ছিনতাই চক্র by আল মাসুদ নয়ন

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গভীর রাতে ভ্রাম্যমাণ নিশিকন্যাদের তৎপরতার আড়ালে গড়ে উঠেছে একটি চক্র। আর এই চক্র অভিনব কৌশলে চালিয়ে যাচ্ছে ছিনতাই। এই ছিনতাইকারী চক্রকে সহযোগিতা করে কিছু হিজড়া এবং পুলিশের কিছু অসৎ সদস্য। রাত গভীর হতে শুরু করলেই রাজধানীর প্রতিটি ওভারব্রিজে এই ছিনতাইকারী চক্র অবস্থান নেয়। পথচারীদের আকৃষ্ট করার জন্য এসব ওভারব্রিজে ছিনতাইকারী চক্র ব্যবহার করে নিশিকন্যা এবং হিজড়াদের।
শুক্রবার রাত ২টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁও মোড়, পরিবাগ, সংসদ ভবনের সামনে এবং মিন্টু রোডের পাশের রমনাপার্ক এলাকায় ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে রাত ১২টার পর থেকেই একদল হিজড়া এবং নিশিকন্যা ভিড় জমায়। তাদের ইঙ্গিতপূর্ণ  আচরণে আকৃষ্ট হয় পথচারীরা। এক পর্যায়ে সাধারণ পথচারীরা তাদের খদ্দেরে পরিণত হয়। তখনই শুরু হয় অভিনব ছিনতাইয়ের খেলা। এসব নিশিকন্যা ও হিজড়াদের পেছনে ওঁৎ পেতে থাকা ছিনতাইকারীরা ওই খদ্দেরদের মোবাইল, মানিব্যাগ, সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে ছেড়ে দেয়।

এ ছাড়া আগে থেকে ঠিক করে রাখা পুলিশ সদস্যরাও ওই খদ্দেরদের ধরে হেনন্থা করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থ আদায় করে ছেড়ে দেয় পুলিশ।

বাংলানিউজের রাতের টিম রাজধানীর পরিবাগ ওভারব্রিজের ওপর দিয়ে রাত আড়াইটার দিকে উঠতে শুরু করলে স্টাফ ফটোগ্রাফার দেলোয়ার হোসেন বাদলের ক্যামেরা দেখে ঝটপট দৌড়ে ব্রিজের নিচে নেমে যায় ছিনতাইকারী দলের বেশকিছু সদস্য। কিন্তু খদ্দেরদের আকৃষ্ট করার টোপ হিসেবে তারা যাকে ব্যবহার করে সে হিজড়া সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। কাছে গিয়ে কথা বলে বোঝা যায় তিনি একজন হিজড়া।

দেলোয়ার হোসেন বাদল সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। তিনি নাম পরিচয় না জানানোর শর্তে কথা বলতে রাজি হন। এ ক্ষেত্রে তার নাম আঁখি (ছদ্মনাম) ব্যবহার করছি।

আঁখি জানান, প্রতিদিন ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত উপার্জন হয়। তবে এ উপার্জন সম্পূর্ণ তার খদ্দের খুশি কর‍ার। এটা কোনো ছিনতাইয়ের টাকা নয়।

আঁখি আরো জানান, ছাত্র, চাকরিজীবী থেকে শুরু সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই রাতে ওভারব্রিজে তার কাছে আসেন। এ ছাড়া রিকশাচালক, সিএনজিচালকসহ নিম্নবিত্তরাও আসেন।

আঁখি জানান, ঈদ কিংবা উৎসবের দিনে উপার্জন ভালো হয়। হরতালের দিনে কোনো উপার্জন হয় না।

তার কোনো দালাল বা সঙ্গে কেউ রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, তার কোনো দালাল নেই। সাধারণত মেয়েদের দালাল থাকে, কারণ তারা ভয় পায়।

পুলিশকে কোনো টাকা দিতে হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার করেন।

কথা বলতে বলতে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হন শাহবাগ থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক আউয়াল। তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই হনহন করে চলে যেতে থাকেন।

এ সময় তাকে ছিনতাইয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি ওভারব্রিজের ওপর কোনো ছিনতাই হয় না।’

এরপর বাংলানিউজের রাতের টিম উপস্থিত হয় মিন্টো রোডে। সেখানে রমনাপার্কের পাশে দেখা গেল একদল হিজড়া। পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন কয়েকজন রিকশাচালক। গাড়ি থেকে আমাদের নামতে দেখেই হিজড়ারা সতর্ক অবস্থান নেয়। তাদের ছবি তুলতে চাইলে বাধা দেন। বলে কয়ে রাজি করানোর চেষ্টা করা হলেও তারা ছবি তুলতে দিতে নারাজ। এক পর্যায়ে কৌশলে ছবি নিতে গেলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং বাংলানিউজের রাতের টিমের ওপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় রমনা থানার উপ-পরিদর্শক সোহেল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হতেই তারা পালিয়ে যেতে শুরু করেন। তাদের সম্মিলিত আক্রমণের হাত আমরা রক্ষা পাই।

এ ব্যাপারে রমনা থানার উপ-পরিদর্শক সোহেল বলেন, ‘ভাই এদের যন্ত্রণায় রাতের বেলাতেও একটু স্বস্তিতে থাকতে পারি না। এদের সহযোগিতা করে রিকশাওয়ালারা। রাতে যারা রিকশা চালায়, তারাই এদের সহযোগিতা করে।

তিনি ছিনতাই প্রসঙ্গে বলেন, ‘রমনা পার্কে এখন আর ছিনতাই হয় না। প্রতিরাতেই এখানে টহলদল কাজ করছে। ১০ বছর আগের রমনা  পার্ক আর এখনকার রমনাপার্ক এক নয়।’

এরপর বাংলানিউজের রাতের টিম উপস্থিত হয় হোটেল সোনারগাঁও মোড়ের হোটেল সুন্দরবনের সামনে পান্থকুঞ্জ পার্কের কাছে। সেখানে দেখা যায় বেশকিছু ভ্রাম্যমাণ নিশিকন্যা।

কারো নাম-পরিচয় না প্রকাশ করার শর্তে কথা হয় তাদের সঙ্গে। এবারও দেলোয়ার হোসেন বাদল অগ্রগামী।

পলি (ছদ্মনাম) নামের এক নিশিকন্যা বাংলানিউজকে জানান, রাত ১২টার পর থেকেই এখানে খদ্দের আসতে শুরু করে। সাধারণত কারওয়ান বাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ী এবং শ্রমিকরা তাদের কাছে বেশি আসেন। তবে যারাই আসছেন, পুলিশ তাদের ধরে কিছুক্ষণ রেখে ছেড়ে দিচ্ছেন। পুলিশ অতিমাত্রায় জ্বালাতন করার কারণে আজ উপার্জন নেই। সাধারণত প্রতিদিন ২০০ থেকে ৫০০ টাকা উপার্জন হয়।

পলি জানান, তার বিয়ে হয়েছে। ১০ বছরের একটি মেয়ে এবং ৭ বছরের এক ছেলে রয়েছে তার। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। ছেলেমেয়েরা জানেন তিনি কারওয়ান বাজারে কাঁচামালের দোকানে কাজ করেন।

পলি আরো জানান, বেশ কিছুদিন গ্রামে থেকে তিনি বুধবার ঢাকায় এসেছেন। এসে দেখেন বাড়িওয়ালী তার ঘরের সব আসবাবপত্র বিক্রি করে ভাড়ার টাকা হিসেবে নিয়েছেন। তিনি ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাতে গ্রামে গিয়েছিলেন। বিয়ে হলেও স্বামী এখন তার কোনো খোঁজখবর নেয় না।

অপর নিশিকন্যা মলি (ছদ্মনাম) জানান, তিনি প্রায় ৫ থেকে ৬ বছর এ কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন।

বিউটি (ছদ্মনাম) নামের একজনকে দেখে মনে হলো বয়স ১৪/১৫ বছর। তাই তার বয়স কত জানতে চাইলে খিলখিল করে হেসে উত্তর দিলো তার বয়স ২৫ এবং তিনি ২ সন্তানের জননী।

তার সঙ্গে কথা বলে আরো জানা গেল, কিছুদিন আগে তিনি এক সন্তানকে বিক্রি করেছেন ৩০০ টাকায়। কেন বিক্রি করেছেন প্রশ্ন করলে একটু আক্ষেপ করে বললেন, ‘তার পরিচয় কি দেব?’

No comments

Powered by Blogger.