অনিয়মের হোতারা এখনও শাস্তি পায়নি by তৌফিক আহমদ চৌধুরী

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য অর্থের জোগান বাড়ানো হচ্ছে। ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বাধীন
তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী একের পর এক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে না। এ নিয়ে আলোচনা করেছেন বাজার সংশ্লিষ্ট দু'জন বিশেষজ্ঞ

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে অস্থিরতা চলছে। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে অভাবনীয় ধসের পর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রণোদনাই কাজে আসছে না কেন? যে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তারা কেন ভরসা পাচ্ছে না?
একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের শেয়ারবাজার তখনই চাঙ্গা হয়, যখন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা আকর্ষণবোধ করে। এ কারণে তাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। আমরা জানি, যখন কোনো ব্যাংক ব্যর্থ হয় তখন আমানতকারীরা তাদের অর্থ ফেরত পায়। কোনো ব্যাংক বিপন্ন দেখলে তাদের ব্যাংক পরিবর্তনেরও সুযোগ থাকে। কিন্তু শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুঁকি আছে, প্রটেকশন নেই। নীতিনির্ধারক মহল থেকে তাদের এটা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। বাজার অতিমূল্যায়িত হয়ে উঠছে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যায় এবং বিপুলসংখ্যক সাধারণ বিনিয়োগকারী প্রকৃত অর্থেই পথে বসে। তাদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। কাদেরই-বা 'ক্ষুদ্র' হিসেবে চিহ্নিত করা হবে, সেটাও প্রশ্ন। তদন্ত কমিটির সঙ্গে যুক্ত থাকার সময় দেখেছি, বিও অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ৩৩ লাখের বেশি হলেও সক্রিয় অ্যাকাউন্ট ছিল ১০ থেকে ১২ লাখ। আবার বিনিয়োগকারীর যে সংজ্ঞা, তাতেও তাদের বেশিরভাগকে ফেলা যাবে না। তাদের বরং বলতে পারি ট্রেডার বা ব্যবসায়ী_ আজ কিনে লাভ দেখলে কালই বিক্রি করে দেয়।
এসব বিনিয়োগকারীর বেশিরভাগ সেকেন্ডারি মার্কেটের সঙ্গে যুক্ত। তাদের সঙ্গে যারা প্রতারণা করেছে, তাদের অনেককে তদন্ত কমিটি চিহ্নিত করেছে। কীভাবে অনিয়ম করা হয়েছে, তার ধারণা দেওয়া হয়েছে। সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) দায়িত্ব ছিল, এ সূত্র ধরে অধিকতর তদন্ত পরিচালনা করে বাজারে ম্যানিপুলেটরদের শাস্তির ব্যবস্থা করা। কিন্তু গত এক বছরে এ পথে অগ্রগতি নেই।
প্রাইমারি মাকের্টে অর্থাৎ শেয়ার ইস্যু করার প্রক্রিয়াতেও ছিল বড় ধরনের গলদ। প্রাইভেট প্লেসমেন্ট, শেয়ারের মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি, বুক বিল্ডিং এ ধরনের অনেক সমস্যার কথা আমরা জানি। কোম্পানির নিট সম্পদ অনেক বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে কিংবা আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এমন অনেককে প্রাইমারি শেয়ারের ভাগ দিয়ে মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা হয়েছে। এর একটিই উদ্দেশ্য ছিল_ অনিয়ম নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাওয়া। অনেকেই বলেন, প্রাইভেট প্লেসমেন্ট বাজারকে কলুষিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও তা চিহ্নিত। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ শাস্তি পায়নি।
একটি বিষয় অনেকেই বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই শেয়ারবাজারে অস্বাভাবিক উত্থান-পতন ঘটে। এটা কি কাকতালীয়? নাকি এ ধরনের সরকার শেয়ারবাজার কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে পারে না? এটা ঠিক, ১৯৯৬ এবং ২০০৯ সালে এ দলটি ক্ষমতায় থাকার সময়েই শেয়ারবাজার বেশি সক্রিয় ছিল। দেখা গেছে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এ বাজারের প্রতি খুব একটা মনোযোগ প্রদান করেননি। তবে এবারের বাজারের ঊর্ধ্বগতি শুরু হয়েছিল কিন্তু ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসায় অর্থনীতির অবস্থা ক্রমে ভালো হতে থাকবে, এমন সম্ভাবনা দেখতে থাকে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা। তবে এটা মনে রাখতে হবে যে, অর্থনীতি সবল পায়ে দাঁড়াতে শুরু করেছে, এমন ভেবে দলে দলে বিনিয়োগকারীরা বাজারে ছুটে আসেনি। এমনটি হলে সেটাই হতো পুঁজি বাজারের জন্য আদর্শ পরিস্থিতি। অনেক দেশে আমরা দেখি যে, উৎপাদনশীল খাত, বিশেষ করে শিল্প খাতে ইতিবাচক পরিবর্তনের খবর পেলেই বাজারের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। আবার ম্যাক্রো অর্থনীতি আরও ভালো করার জন্যও শেয়ারবাজারকে কাজে লাগানো হয়। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এর কোনোটিই ঘটেনি। এখানে সাধারণ ধারণা থেকে এমনকি গুজব শুনেও বাজারে মূলধন নিয়ে ছুটে আসে অনেকে। তারা এমনকি ধার করেও পুঁজি নিয়ে হাজির হয়। কিন্তু শেয়ারের চাহিদার সঙ্গে সরবরাহে বিপুল ঘাটতি থাকে এবং পরিণতিতে শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে। এ সুযোগ নেয় ম্যানিপুলেটররা। তদন্ত কমিটি তার কাজ পরিচালনা করতে গিয়ে ক্ষুদ্র বা বড় বিনিয়োগকারীরা কে কোন দল করে, সেটা দেখার চেষ্টা করেনি। কিন্তু রাজনীতি ও অর্থনীতির অন্দর মহলের খবর যারা জানেন, তারা নিশ্চিতভাবেই লক্ষ্য করেছেন, সেকেন্ডারি মার্কেট থেকে ট্রেড করে যারা দু'হাতে অর্থ কামিয়েছে তাদের মধ্যে প্রধান দলগুলোর নেতাকর্মীরা রয়েছেন। আবার কোনো দলের সঙ্গে নিজেদের তেমন চিহ্নিত করতে চান না, এমন ব্যক্তিরাও রয়েছেন।
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ম্যাক্রো অর্থনীতি নিয়ে ভাবেনি। তারা সম্পদ বিক্রি করেছে, পরিচিতজন কিংবা ব্যাংক থেকে টাকা চেয়ে এনেছে। প্রাতিষ্ঠানিক কিছু বিনিয়োগকারীও এসেছে। কেউই দীর্ঘমেয়াদে বাজারে থাকার কথা ভাবেনি। সেকেন্ডারি মার্কেটের কেনাবেচা যে নতুন কলকারখানা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কোনো কাজে লাগে না, সেটাও তাদের বেশিরভাগের জানা নেই। বাজারে তাদের দলে দলে টেনে আনার জন্য পরিকল্পিতভাবেই বলা হয়েছে, শেয়ারবাজার অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দিচ্ছে। এটা যারা করেছে, তারা অর্থ মন্ত্রণালয়, সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ অফিস সর্বত্র যাতায়াত করে। তারা প্রভাব খাটাতে জানে। মুখ বন্ধ করার কৌশল জানে। এখন তারা বাজারের পতন দেখে চুপচাপ আছে। যত প্রণোদনাই দেওয়া হোক না কেন, তাদের এ মুহূর্তে মতিঝিল কিংবা আগ্রাবাদের ব্রোকারদের অফিসগুলোতে টেনে আনা যাবে না। সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো ব্যাংকগুলোকে বলতে পারে যে শেয়ারবাজারে কিছু পুঁজি খাটাও। কিন্তু ব্যক্তিকে তারা কীভাবে বলবে?
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য আদর্শ বাজার সেকেন্ডারি নয়, বরং প্রাইমারি মার্কেট। এখানে পুঁজি খাটালে তা সরাসরি উৎপাদনশীল খাতে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে তেমনটি ঘটছে না। আমরা স্টক এক্সচেঞ্জ অটোমেশন করেছি। কিন্তু সেকেন্ডারি মার্কেটে অনিয়মের সুযোগ এখনও রয়েছে। বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টাও সফল হয়নি। অর্থমন্ত্রী সরকারের হাতে থাকা বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার বিক্রির জন্য অনেকবার চূড়ান্ত সময় বেঁধে দিয়েছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা তাতে গুরুত্ব দেয় না। অথচ এই সেকেন্ডারি মার্কেটেই দলে দলে মানুষ ছুটে এসেছিল ভাগ্য ফেরানোর আশায়। এ কারণে বিভিন্ন সরকারি ও আধা-সরকারি অফিসে কাজে ফাঁকি বাড়ে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পদস্থরা কর্তব্যে গাফিলতি করেন। এমনকি নিয়ন্ত্রক সংস্থা যেমন সিকিকিউরিটিজ কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইসিবির মতো প্রতিষ্ঠানের বড় বড় অফিসার থেকে কর্মী পর্যন্ত অনেকেই মেতে থাকে দৈনন্দিন লেনদেন নিয়ে। গৃহবধূ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই ছিল বাজারমুখী।
লাখ লাখ বিনিয়োগকারী বাজারে ফিরে আসুক, সেটা অবশ্যই চাইব। কিন্তু তার আগে বাজার দেখভাল করার দায়িত্ব যেসব প্রতিষ্ঠানের, সেগুলো ঠিক করতে হবে। তদন্ত কমিটি এ বিষয়ে নির্দিষ্ট সুপারিশ রেখেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সবগুলো কার্যকর করা হয়নি। ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে ম্যানেজমেন্ট ও ব্রোকারদের পৃথক করার সুপারিশও তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। ট্রেডার এবং বোর্ড সদস্য অভিন্ন হলে ম্যানিপুলেশনের সুযোগ বাড়ে। তদন্ত কমিটি অনিয়মের বিষয়ে যেসব ইঙ্গিত দিয়ে অধিকতর তদন্তের সুপারিশ করেছিল, সেগুলোও গুরুত্ব দাবি করে। এর ভিত্তিতে অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা করা যায়। কিন্তু তা হয়নি। অনিয়মের সঙ্গে চিহ্নিতরা সক্রিয় থাকায় অনেক আলামত নষ্ট করে ফেলাও অসম্ভব নয়। সরকার যদি চিহ্নিত রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করত তাহলেও হয়তো বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারত এবং একই সঙ্গে বাড়ত তাদের ভাবমূর্তি।

স ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী : সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি এবং সদস্য শেয়ারবাজার তদন্ত কমিটি

No comments

Powered by Blogger.