প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এশিয়া কাপ by তারেক মাহমুদ

শেয়ারবাজারে লেনদেন কমে গিয়েছিল। দেশের প্রধানমন্ত্রী আর বিরোধীদলীয় নেত্রী কিছু সময়ের জন্য চলে এসেছিলেন পাশাপাশি ফ্রেমে। টিএসসিতে হাজারো জনতার ভিড়। এশিয়া কাপের ফাইনাল গোটা জাতিকে বেঁধে ফেলেছিল বিনি সুতার মালায়।

রাত পেরিয়ে সকাল হলো। কিন্তু পুরো দেশই যেন আচ্ছন্ন আগের রাতের ফাইনালে। দল-মত, ধর্ম-বর্ণের বিভেদ ভুলে সবাই আক্রান্ত না পাওয়ার বেদনায়। রাস্তাঘাটে সবার মুখে একটাই কথা। চায়ের দোকান থেকে অফিস-আদালত—সব জায়গাতেই আফসোস। ইশ্, একটুর জন্য হলো না!
সবচেয়ে বেশি আফসোস তো ক্রিকেটারদেরই। পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব মেলানোর ভার তাঁদের হাতেই ছিল। ক্রিকেটাররা ভালোই জানতেন, আর ৩টি রান করে ফেলতে পারলে কী হতো এ দেশে!
সেটা আর হয়নি। দেশ ভাসেনি আনন্দস্রোতে। সেই হতাশায় ক্রিকেটারদের বুকে নীরব রক্তক্ষরণ। কাল সকালের ফ্লাইটে চট্টগ্রামে চলে যাওয়ার কথা ছিল নাজিমউদ্দিনের। যাননি টিম স্পনসরদের ডিনার আছে বলে। সেটা সেরে রাতের বাসে যেতে হবে। নাজিমউদ্দিনকে সে জন্যই একটু চিন্তিত লাগল। প্লেনে গেলে তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। বাসে ছয়-সাত ঘণ্টার পথ। কটু মন্তব্য শোনার আশঙ্কাও বেশি। ভাই, কেন হারলেন? আপনার জন্যই তো...!
এশিয়া কাপের ফাইনালে হারের নানা রকম ‘ময়নাতদন্ত রিপোর্ট’ পাওয়া যাচ্ছে। কোনো রিপোর্টে হারের দায় নাজিমউদ্দিনের কচ্ছপ গতির ব্যাটিংয়ের। কেউ বলছেন, শেষ ওভারে শাহাদাত হোসেনের দেওয়া ১৯ রানই সর্বনাশের কারণ। কারও কারও প্রশ্ন—নাসির হোসেনই বা অমন খোলসের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলেন কেন?
সোনারগাঁও হোটেলে কাল দুপুরের মধ্যে বাংলাদেশ দলের রুমগুলো প্রায় খালি। পরশু খেলা শেষে হোটেলে ফিরে রাতেই লাগেজ গুছিয়ে বাসায় চলে গেছেন তামিম ইকবাল। অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম হোটেল ছেড়েছেন কাল ভোরে। এরপর একে একে বিদায় নিয়েছেন সহ-অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ, আবদুর রাজ্জাক, সাকিব আল হাসান, মাশরাফি বিন মুর্তজারা। চট্টগ্রামে যাবেন বলে থেকে গেছেন শুধু নাজিমউদ্দিন।
হতাশায় রাতে ঘুম হয়নি ঠিকমতো। কালও একাকী হোটেল রুমে বারবার আগের রাতটাই ফিরে আসছিল। কোনো প্রশ্নের কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না নাজিমউদ্দিন, ‘ওদের বলগুলো কি বেশি ভালো হচ্ছিল, নাকি আমিই পারছিলাম না! কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। ২ রানের হার মেনে নেওয়া যায় না।’
মানতে পারছে না কেউই। যদিও পরশু ম্যাচ শেষের টিম মিটিংয়ে না পাওয়ার বেদনার চেয়ে প্রাপ্তির কথাই বেশি বলেছেন কোচ স্টুয়ার্ট ল। কোচের কাঠগড়ায় পরাজয়ে দোষী নন কেউই। হারটাকে অতীত ভেবে তিনি তাকাতে চাচ্ছেন সামনে। যে টুর্নামেন্টে ফাইনালে ওঠার চিন্তাও করেনি বাংলাদেশ, সেটিতে মাত্র ৩ রানের জন্য চ্যাম্পিয়ন হতে না পারাটাও ল-র কাছে বড় প্রাপ্তি।
আগের রাতের ধাক্কা কাল সকালেও সামলে উঠতে পারছিলেন না আবদুর রাজ্জাক। ‘এ রকম সুযোগ আগে কখনো পাইনি। মনের অবস্থা ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। রাতে ভালো ছিলাম না, এটুকু বলতে পারি।’ ঘরে ফেরার আগে বলছিলেন হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে। তবে হতাশার রাত শেষে অভিজ্ঞ বাঁহাতি স্পিনার নতুন আশার আলোও পাচ্ছেন কোচের কথায়, ‘এটা নতুন দিনের সূচনা। আমরা চেষ্টা করব এখান থেকে পেছনে না গিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে।’
রাজ্জাককে বিদায় দিয়ে কাউন্টারে বিল মেটাচ্ছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। সাংবাদিক, টেলিভিশন ক্যামেরা দেখে প্রথমে কথাই বলতে চাইলেন না। কী বলবেন? বলতে তো হবে হতাশার কথাই! না, মাশরাফি অর্জন দিয়ে শুরু করলেন, ‘এশিয়া কাপে অর্জন অনেক। ফাইনালে হেরে সবাই হতাশ হলেও আমরা অনেক কিছু শিখেছি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, যেকোনো দলকে হারানোর বিশ্বাসটা এসেছে। এত দিন হয়তো মুখে বলতাম, বিশ্বাস রাখতে হবে। এখন বুঝতে পারছি, যেভাবে খেলি আমরা তার চেয়ে অনেক ভালো দল।’
সাকিবের নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া, তামিমের ধারাবাহিকতা, একসঙ্গে অনেকের জ্বলে ওঠা—সবই প্রাপ্তির খাতায় রাখতে চান মাশরাফি। রাখতে পারেন বোলিংয়ের মতো ফাইনালে নিজের ব্যাটিংটাও। অনেক দিন পর ব্যাট হাতেও যে আবার ম্যাচ উইনার মনে হচ্ছিল মাশরাফিকে!
ভারত ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচের মতো ফাইনালে সত্যিকারের ম্যাচ উইনার হতে পারতেন সাকিবই। পারলেন না বলে আফসোস তাঁরও, ‘আমার কাছে সবাই এমন কিছুই আশা করে। কিন্তু পারিনি।’ তবে এক এশিয়া কাপেই তো আর সব শেষ নয়! ‘সব সময়ই পরের বার বলে কিছু থাকে।’ হাসতে হাসতে ভবিষ্যতের আশা বাঁচিয়ে রাখলেন এশিয়া কাপের সেরা খেলোয়াড়।
আগের রাতে এই হাসিটাই উধাও হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষের কাছে ২০১২ এশিয়া কাপের স্মৃতি হয়ে থাকবে ফাইনাল শেষে সাকিবের অশ্রুসিক্ত ছবি। সাকিবও স্বীকার করলেন, বড় কষ্টে কেটেছে একটা রাত, ‘আবেগের রাতই গেছে একটা। সবাই হতাশায় ডুবে গিয়েছিল।’ এক রাতের মধ্যে হতাশা কাটিয়ে কাল সাকিব আবার পুরোনো সাকিব, ‘হারার পর পরই আবেগটা বেশি ছিল। পরে সবাই উপলব্ধি করেছি, এখান থেকে অর্জনটা কী। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের এখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার সময়।’
জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমানে ধারাভাষ্যকার আতহার আলী খান এটাকে বলছেন ‘বিরাট পরিবর্তন’। ফাইনালে হারলেও তাঁর দৃষ্টিতে এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশই, ‘এশিয়া কাপের সবচেয়ে বড় দাবিদার বাংলাদেশই। টুর্নামেন্টের সেরা দল তারা। দে আর পিপলস চ্যাম্পিয়ন। ক্রিকেট বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ তাদেরই চ্যাম্পিয়ন বলছে। এত আত্মবিশ্বাস এর আগে দেখিনি দলটার মধ্যে। এখান থেকে বাংলাদেশ আর পেছনে যাবে না।’
এশিয়া কাপে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বোধহয় এটাই।

No comments

Powered by Blogger.