বুদ্ধপূর্ণিমা-বিশ্বশান্তি ও সাম্যনীতি by সুকোমল বড়ুয়া

আজ মহান বুদ্ধপূর্ণিমা। ২৫৫৫ বুদ্ধাব্দ। দিনটি বিশ্বের সব প্রপীড়িত মানবগোষ্ঠীর জন্য এক পরম তিথি। এই দিনেই গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আড়াই হাজার বছরেরও অধিক আগে খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৪ অব্দে। ছয় বছর কঠোর তপস্যার পর এই দিনেই তিনি আবার বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। দীর্ঘ ৪৫ বছর ধর্ম প্রচারের পর তিনি আবার একই তিথিতে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেছিলেন। প্রতিবছর মহান এই বুদ্ধপূর্ণিমা উদ্যাপনের মধ্য দিয়েই আমরা গৌতম বুদ্ধের মানবতাবাদী শিক্ষা, তাঁর জীবনদর্শন এবং উত্তম মানবজীবন গঠনের লক্ষ্যে সুন্দর, সৎ ও আলোকিত আদর্শের এক অপূর্ব শিক্ষা লাভ করি; যা ইহজাগতিক এবং পারমার্থিক উভয় জীবনের জন্য অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ।
বৌদ্ধমতে শীল সমাধি প্রজ্ঞাময় জীবনের মধ্য দিয়েই একজন মানুষের সর্বোত্তম জীবন গড়ে ওঠে, যেখানে তিনি হন ন্যায়পরায়ণ, বিবেকবান ও আত্মসচেতন। আমি কে, আমার করণীয় কী, ভালো-মন্দ কী কাজ করা উচিত কিংবা অনুচিত, আমার কর্মে আমি নিজেই সন্তুষ্ট কি না, সর্বোপরি আমার কর্মে মানবজাতি উপকৃত হচ্ছে কি না—এসব বিষয় চিন্তা করাই হলো বৌদ্ধভাবনা। একজন মানুষ এসব চিন্তা করতে গেলেই তার জীবন সম্পর্কে, করণীয় সম্পর্কে এবং কর্মের শুভাশুভ সম্পর্কে অনায়াসে ভাবতে পারবে। এতে আত্মজীবন যেমন বিশ্লেষণ করা যায়, তেমনি জীবন-সচেতনতাও বৃদ্ধি পায়।
বৌদ্ধধর্মের মূলনীতি হচ্ছে অহিংসা এবং সাম্য মৈত্রী ও প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সহাবস্থান করা। শুধু বৌদ্ধধর্মে কেন, অন্যান্য ধর্মের মধ্যেও এসব নীতির কথা উচ্চারিত হয়েছে। তবে ভিন্নতা শুধু, বৌদ্ধধর্মে সব প্রাণীকে মমতার বন্ধনে আবদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। সব প্রাণীর জীবন রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। তাই বৌদ্ধধর্মের পঞ্চনীতির প্রথম নীতিতে বলা হয়, আমি প্রাণী বধ থেকে বিরত থাকব—এই শিক্ষানীতি গ্রহণ করছি। পঞ্চশীলে আরও আছে—কোনো ধরনের চৌর্যবৃত্তি করব না, কোনো অবস্থাতেই মিথ্যা কথা বলব না, অবৈধ কামাচার করব না, কোনো ধরনের নেশাদ্রব্য সেবন করব না—এগুলোই মানুষের পরম নীতি। এগুলোই তো মানুষকে মনুষ্যত্বে নিয়ে যায়। এই পাঁচ নীতি যথার্থভাবে পালন করাই হচ্ছে পঞ্চশীল পালন করা, অর্থাৎ সুনীতিপরায়ণ হওয়া। সৎ বাক্য, সৎ কর্ম, সৎ চিন্তা, সৎ জীবিকা, সৎ প্রচেষ্টা, সৎ স্মৃতি, সৎ সাধনা ও সৎ সমাধি—এই আটটি উপাদানও মানবজীবনের জন্য সুনীতি গঠনের ভিত তৈরি করে, যা বৌদ্ধ পরিভাষায় আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলে পরিচিত। এসব সুনীতি বৌদ্ধধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং মহিমায় উজ্জ্বল। বলতে গেলে এসব নীতি বৌদ্ধধর্মের ব্যাসিক এবং ফান্ডামেন্টাল নীতি।
আমরা এও জানি, হিংসা ও অহিংসা শব্দ দুটো পরস্পর বিপরীতমুখী। একটি মন্দ অর্থে, অন্যটি সদর্থে ব্যবহূত হয়। হিংসা মানুষকে পশুতে পরিণত করে, অন্যদিকে অহিংসা মানুষকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করে মানবীয় ধারায় বিকশিত করে।
আজ গোটা বিশ্বে অহিংসা নীতিবাদের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বের সর্বত্রই যেন হিংসার রাজ্য প্রতিষ্ঠিত। সমাজ, দেশ, তথা রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে হিংসার দৌরাত্ম্য যেন আজ পদে পদে। তাই আজ মানুষ পরস্পর পরস্পরকে বঞ্চনা করছে, অন্যের জীবননাশ এবং ক্ষতি করার জন্য সদা ব্যাপৃত রয়েছে। সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও সৌভ্রাতৃত্ববোধের অভাব দারুণভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমরা আজ জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিক্ষা-দীক্ষায় এত উন্নত হয়েও অতি প্রাচীন যুগের গুহাবাসী হিংস্র প্রাণীর চেয়েও খারাপ হয়েছি। প্রতিদিনের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা মানুষের হূদয়কে ব্যথিত করে, ভারাক্রান্ত করে তোলে। শিক্ষার নামে চলছে বন্দুকযুদ্ধ, চলছে সহিংসতা আর গণতন্ত্রের নামে চলছে হাতাহাতি, বাক্যুদ্ধ এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য চলছে ট্যাংক, মিসাইল ও বোমাযুদ্ধ। একটি যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই আরেকটি যুদ্ধ শুরু হয়। এগুলোই কি সত্যিকার গণতন্ত্র? এসব ক্রিয়াকাণ্ড তো অহিংস নীতিবাদের মধ্যে আসে না। সত্যিকারের গণতন্ত্র, সাম্য ও অহিংসা মানুষকে প্রেম, প্রীতি, করুণা ও ভালোবাসার মন্ত্র শেখায়। একে অপরকে হূদয় দিয়ে গ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে, মনের উদারতায় নিজেকে স্নাত-স্নিগ্ধ করার শিক্ষা দেয়। তাই অহিংসবাদের প্রবর্তক মহামতি গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন, বৈরিতা দিয়ে বৈরিতা, হিংসা দিয়ে হিংসা কখনো প্রশমিত হয় না। অহিংসা দিয়ে হিংসাকে, অবৈরিতা দিয়ে বৈরিতাকে প্রশমিত করতে হবে—এটাই জগতের সনাতন নীতি।
আজকের দিনে গৌতম বুদ্ধের সেই আড়াই হাজার বছরেরও আগের বাণীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে বলতে হয়, সন্ত্রাস সন্ত্রাসেরই জন্ম দেয়, অস্ত্র দিয়ে সন্ত্রাস কখনো বন্ধ করা যায় না। অন্যভাবে বললে বলতে হয়, ‘বৈরিতা বৈরিতার জন্ম দেয়, হিংসা প্রতিহিংসার জন্ম দেয়।’ সুতরাং হিংসা প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজন অহিংসা, প্রেম, করুণা, ক্ষমা, মৈত্রী কিংবা ভালোবাসা। মৈত্রী দিয়ে, ক্ষমা দিয়ে কিংবা ভালোবাসা দিয়ে শুধু নিজেকে নয়, বিশ্বকেও জয় করা যায়। গৌতম বুদ্ধ হলেন তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বুদ্ধ বলেন, মৈত্রীর অনন্ত গুণ, অহিংসার অনন্ত গুণ। অতএব, এই অনন্ত গুণ দিয়েই একটি বাসোপযোগী মানববিশ্ব গঠন করা যায়। সুতরাং বিশ্ব মৈত্রী ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ গঠন করার জন্য মহামতি বুদ্ধের বাণীর কোনো তুলনা নেই। এর জন্য প্রয়োজন অহিংসা, অবৈরিতা ও প্রীতিবোধের উদ্বোধন। আজ যদি সমাজ, দেশ তথা রাষ্ট্রের সব বিবেকবান মানুষ হিংসার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং কেউ যদি হিংসা ও সন্ত্রাসের রাজত্ব না চায় এবং এর লালন না করে, তাহলে আজকের বিশ্বে আর কোনো রকম হিংসা, হানাহানি কিংবা সন্ত্রাস-নৈরাজ্য আর যুদ্ধ থাকত না। আমাদের অঙ্গীকার হোক, বুদ্ধের সেই নীতিতে যে নীতিতে আমরা পরস্পর পরস্পরকে হূদয় দিয়ে ভালোবাসতে পারব, উদার মনে একে অন্যকে গ্রহণ করতে পারব এবং দেশের আপামর জনসাধারণ তথা সমগ্র মানববিশ্বের জন্য একটি সুখী সুন্দর ও নিরাপদযোগ্য বসবাস তৈরি করতে পারব।
ড. সুকোমল বড়ুয়া: সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন, বাংলাদেশ চ্যাপ্টার।

No comments

Powered by Blogger.