শ্রদ্ধাঞ্জলি-ইলাদিকে যেমন দেখেছি by রীনা হেলাল

ইলা মজুমদার একটি নাম, সদা হাস্যময়ী, শান্ত-ধীর-স্থির, সাদাসিধে একজন রমণী, যাঁর মমতাময়ী স্নেহে বড় শিল্পী হয়েছেন অনেকে। পরিবারে দুই ছেলে, তাঁদের বউ, নাতিনাতনি নিয়ে সংসার। প্রয়াত শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পীর স্বামী বারীন মজুমদারের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে ছিলেন। বড় ছেলে পার্থ মজুমদার, ছোট ছেলে বাপ্পা মজুমদার প্রতিষ্ঠিত সংগীতশিল্পী।

তাঁদের দত্তক পুত্র পার্থপ্রতিম মজুমদার প্রতিষ্ঠিত মূকাভিনেতা, যিনি বর্তমানে প্যারিসে আছেন এবং সম্প্রতি মূকাভিনয়ে পারদর্শিতার জন্য নাইট উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন (তিনিই প্রথম বাঙালি, যিনি এই বিরল সম্মানের অধিকারী হলেন)। ইলাদিকে আমি প্রথম দেখেছি ১৯৬২ সালের দিকে। আমরা পাবনায় একই পাড়ার বাসিন্দা। তাঁর বাবা অনীল মজুমদার আইনজীবী ছিলেন, আমার বাবাও আইনজীবী ছিলেন, সেই সূত্রে আমাদের পরিচয়। তখন ইলাদি কলেজ ছেড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। স্কুল ফাইনাল উনি প্রাইভেট দিয়ে পাস করেছিলেন, এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়েছিলেন। ইলাদির বাবা শিক্ষিত, বনেদি পরিবার হলেও গোঁড়া ছিলেন। তাঁদের পরিবারের মেয়েদের বাইরে দেখা যেত না।
আব্বার সঙ্গে অনীল কাকাবাবুর বেশ বন্ধুত্ব ছিল, সময় পেলেই কাকাবাবুর বাসায় যেতেন কিন্তু আমাদের যাওয়া-আসা ছিল না। আমরা তখন জানতাম কাকাবাবুর ছেলেমেয়ে আছে। মেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। এরপর একদিন আমি রিকশায় করে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ দেখি একটি মেয়ে ছোটখাটো, ফরসা; ব্যাগ নিয়ে নামছে রিকশা থেকে। মনে হলো, ইনিই হয়তো কাকাবাবুর মেয়ে। তখন শুনেছি কাকাবাবুর মেয়ে উচ্চাঙ্গসংগীতের শিল্পী ইলা মজুমদার। তখন কেবল ছাত্রী। এর পরপরই একদিন শুনলাম কাকাবাবুর মেয়ে ইলার বিয়ে হয়েছে পাবনা শহরের বনেদি পরিবারের ছেলে উচ্চাঙ্গসংগীতের শিল্পী বারীন মজুমদারের সঙ্গে। বারীন মজুমদার থেকে ইলাদির বয়সের তফাৎ ছিল বেশ। এ বিয়ে কাকাবাবু কখনো মেনে নেননি। ইলাদির সঙ্গে পরে আর আমার অনেক দিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই।
এরপর বহুদিন কেটে গেছে। আমার বিয়ে হয়েছে, পাবনা থেকে চলে এলাম স্বামীর কর্মস্থলে। আমরা তখন রেডিওতে প্রায়ই শুনতাম উচ্চাঙ্গসংগীতজ্ঞ বারীন মজুমদার ও ইলা মজুমদারের নাম। তখন রেডিওর যুগ ছিল, সবাই রেডিও শুনত।
এরপর দেশ স্বাধীন হলো, আমরা সবাই কে কোথায় ছিটকে পড়লাম। ঘুরতে ঘুরতে ঢাকায় চলে এলাম। ১৯৭৪ সালে আমি আবার দেখলাম ইলাদিকে। সেগুনবাগিচায় মিউজিক কলেজে। আমি তখন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে নতুন সদস্য হয়েছি। সেগুনবাগিচায় আমাদের অফিস। একদিন মিউজিক কলেজের মাঠে পরিষদের সভায় ইলাদিকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। তিনিও আমাদের সদস্য ছিলেন। তিনি মিউজিক কলেজেই ওপর তলায় থাকতেন। ওই কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন বারীন মজুমদার। তাঁদের অনেক শ্রম, মেধা দিয়ে তৈরি এই কলেজ। এই কলেজকে নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন এবং একই রকম ভালোবাসতেন শিক্ষার্থীদের, যারা তাদের কাছে গান শিখতে আসত।
তখন দেখেছি ইলাদির বাসায় অনেক লোক থাকত এবং খেত। ইলাদি পারতেনও সবদিক সামলাতে। তখনই জানতে পারলাম, ইলাদিরা স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় দুটি ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে যখন জিনজিরা পার হতে নৌকায় উঠছিলেন, তখন তাঁদের একমাত্র মেয়ে মিতু চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়। সেই মেয়েকে হারানোর দুঃখ তাঁদের চিরজীবন তাড়া করে ফিরেছে। মিতুর একটি স্কেচ করা ছিল, সেটাই ছিল তাঁদের কাছে একমাত্র প্রিয় সম্বল। মুক্তিযুদ্ধের পর তাঁরা পার্থপ্রতিমকে দত্তক নেন।
মিউজিক কলেজটি পরবর্তীকালে সরকার নিয়ে নিলে তাঁরা সেগুনবাগিচা থেকে চলে গেলেন মিরপুরে এবং এরপর বহুদিন ইলাদির খোঁজ পাইনি।
তারপর প্রায় ছয়-সাত বছর পর আবার দেখা হলো, আমি তখন মগবাজারে থাকি। হঠাৎ শুনি, আমাদের বাসার সামনের বিল্ডিংয়ের নিচতলায় ইলা মজুমদার ভাড়া নিচ্ছেন। শুনে খুব খুশি হলাম। অবশেষে ওনারা এলেন। আমি ওই দিনই গেলাম তাঁদের বাসায়। গিয়ে দেখি সামনের ঘরে কার্পেটের ওপর বারীনদার হাতে সেতার ও ইলাদি চুল ছাড়া, আটপৌরে শাড়ি পরে তানপুরা হাতে রেওয়াজ করছেন। হঠাৎ দেখে আমার মনে হয়েছিল, যেন কোনো দেবীর হাতে বীণা। অপূর্ব এক রূপ যেন! আমরা আবার ঘনিষ্ঠ হলাম। ইলাদিও আমাকে পেয়ে খুশি। আমার ছোট ছেলের বন্ধু হয়ে গেল বাপ্পা। ইলাদি তাঁদের বাসায় উচ্চাঙ্গসংগীত শেখাতেন ছেলেমেয়েদের।
এরপর মগবাজার থেকে চলে গেলেন সিদ্ধেশ্বরীতে। প্রায়ই যেতাম তাঁদের বাড়িতে, বিশেষ করে বারীনদার জন্মদিনে। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা ওই দিনটি খুব ভালোভাবে পালন করতেন। একসময় তাঁদের দুই ছেলেও সংগীতজগতে পা দিলেন, তাঁরা হলেন ব্যান্ডশিল্পী। ইলাদি আর বারীনদা বর্তমান যুগের সংগীতের সঙ্গে পাল্লা না দিয়ে আজীবন শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে কাটিয়ে দিলেন। কিন্তু প্রাপ্য সম্মান পেলেও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না। বারীনদা মারা গেলেন। এরপর অনেক দিন দেখা হয়নি ইলাদির সঙ্গে। কথা হতো মাঝেমধ্যে। তারপর একদিন হঠাৎ করে কাউকে কিছু না বলে কাউকে কোনো কষ্ট না দিয়ে ইলাদি নিঃশব্দে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন চলতি ২ মে রাতে। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, তাঁর ছাত্রছাত্রী, গুণগ্রাহী—সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন তিনি। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
রীনা হেলাল

No comments

Powered by Blogger.