মাশরাফি বিন মুর্তজা লিখছেন প্রথম আলোয়-কষ্টটা মনের গভীরে থেকেই যাবে

কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। কোত্থেকে শুরু করব তা-ও অজানা। এভাবে হারলে আসলে কিছু বলার থাকে না। আমি দুঃখিত, ব্যথিত। প্রকাশ করার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছি। সৃষ্টিকর্তা না দিলে কী করার আছে বলুন! ভীষণ খারাপ লাগছে। মানতে কষ্ট হচ্ছে, আমরা মাত্র ২ রানের জন্য এশিয়া কাপটা জিততে পারলাম না।

সবই ঠিকঠাক ছিল। কষ্টটা বেশি পাচ্ছি এই জন্য, ৩০-৪০ রানে হারলে মনকে সান্ত্বনা দেওয়া যেত। মাত্র দুই রানের আফসোস থেকে গেল আমাদের। কষ্টটা মনের গভীরে থেকেই যাবে।
বুকের মধ্যে কষ্টটা আজ (কাল) সকাল থেকেই বেশি অনুভব করছি। রাতে টিম হোটেলে ফিরে সবকিছু একরকমভাবে ভেবেছি। কিন্তু ঘুম থেকে ওঠার পর মনে আসছে অনেক ভাবনা। কী হলে কী হতে পারত...কত কিছু!
ক্রিকেট খেলে আমি কম কষ্ট পাইনি। এটাও সত্য, জীবনে যা কিছু পেয়েছি সবই ক্রিকেট খেলে। হয়তো একসময় এশিয়া কাপের এই দুঃখটাও তলিয়ে যাবে। তবে জীবনে সব কষ্টের ওপরে বোধহয় দুই রানের এই কষ্টটা।
১১ মাস পর ক্রিকেটে ফিরেছি। আমি কিছু করে ফেলব—এমন বিশ্বাস অনেকেই হয়তো রাখতে পারেননি। তবে কাল ব্যাট করতে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল, আমি নিজেই জিতিয়ে আসব দলকে। মুশফিক বলছিল, ‘মাশরাফি ভাই আপনি পারবেন।’
পরিকল্পনা ছিল, সামনে যে বোলারই আসবে মারব। আমি এমনিতে পেসের চেয়ে স্পিনটা ভালো খেলি, কিন্তু এই রাতে কোনো বাছবিচার না করে ব্যাট চালাতে চেয়েছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলাম না।
তবু সব শেষ হয়ে গেছে বলে ভাবিনি। তখনো রাজ্জাক ছিল। ভেবেছি হয়ে যাবে। তাই নিজের আউট নয়, দলকে নিয়েই চিন্তা করেছি। শেষ ২ বলে ৪ রান, তখনো আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু শেষ বলটায় দরকার ছিল ৪ রান, স্ট্রাইকে রিয়াদ থাকলে একটু বেশি ভরসা পেতাম। স্ট্রাইকে ছিল শাহাদাত, ও কোনো রকমে পায়ে-টায়ে লাগিয়ে নিতে পারল একটা সিঙ্গেল। জয়টা থেকে গেল ৩ রান দূরে।
এই এশিয়া কাপে আমি যতটুকু পারফর্ম করতে পেরেছি, মোটামুটি ঠিকই আছে বলব। ফিরে আসা ছিল কঠিন, চ্যালেঞ্জিংও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কঠিন এক জায়গা। হ্যাঁ, চ্যালেঞ্জ নেওয়াই আমার কাজ। তবু চাপ থাকেই। আল্লাহকে ধন্যবাদ। তিনি আবার আমাকে মাঠে ফিরিয়ে এনেছেন।
জীবনে অনেক লড়েছি। লড়তে লড়তেই এত দূর আসা। লড়াইটা খেলা নিয়ে ছিল না, ছিল আমার শরীরের সঙ্গে। দেখা যাক, সামনে কীভাবে এগিয়ে যেতে পারি।
চারপাশের সবারই মন খারাপ। নড়াইলে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন সবাই কষ্ট পেয়েছে। স্ত্রী চুপচাপ। বলছে, “তুমি আর দু-তিনটা বল থাকলেই তো হয়ে যেত।” কী আর বলব! স্ত্রীর আফসোস দেখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকি।
এই প্রথম বুঝলাম দেশের ভালোবাসা, মায়া কত বড় প্রেরণা। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী খেলা দেখতে এসেছেন। গলি থেকে রাজপথ, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া—গোটা দেশ কাল ক্রিকেট দলের সঙ্গে ছিল। এটা ধরে সামনে এগোতে পারলে বড় কিছু অর্জন সম্ভব। আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। নিজের জীবন থেকেই সেটি বুঝি। বিশ্বকাপ খেলতে পারলাম না, অনেকে ভাবলেন আমি বুঝি শেষ। কিন্তু আমি ফিরে এসেছি ভালোভাবেই।
টুর্নামেন্ট শুরুর আগে প্রথম আলোয় আমার কলামে লিখেছিলাম, ‘চমকের আশা আপনি করতেই পারেন।’ খেলোয়াড় হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন থাকে মনে, তবে আমরা এশিয়া কাপ খেলব একেকটি ম্যাচ ধরে। শেষ পর্যন্ত আমরা সবাইকে অবাক করে ফাইনাল খেললাম, দুঃখ রইল মাত্র দুটি রানের।
বেশি দুঃখ পেয়েছি সাকিব-তামিমের জন্য। ছেলে দুটি কী অসাধারণ-ই না খেলল! ট্রফিটা ওদের জন্যই জেতা দরকার ছিল আমাদের। ওরা দুজন আর কত করবে দলের জন্য!
সাকিব নিজেকে নিয়ে গেছে অনেক বড় জায়গায়। এত দিন তাকে ঘিরে দলের দু-একজন পারফর্ম করত। এবার গোটা দলই পারফর্ম করেছে। তাই সাকিবকে সামনে রেখে বাংলাদেশকে এখন সবাই নতুন করে চিনবে। কী দারুণভাবেই না তামিম নিজের জাতটা বুঝিয়েছে!
এই টুর্নামেন্টে আমাদের অনেক প্রাপ্তি। অপ্রাপ্তি শুধু ওই ২ রান। পাকিস্তান সফর না হলে আগামী মাস ছয়েক খেলা নেই আমাদের। আবার আন্তর্জাতিক খেলায় ফিরে এসে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারাই হবে আসল প্রাপ্তি।
আমাদের পাশে থাকার জন্য আপনাদের সবাইকে জানাই ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.