চরাচর-তিতাসের মরে যাওয়া by বিশ্বজিৎ পাল বাবু

'তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ার তার তন্দ্রা ভাঙে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতের চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বলে, কিন্তু পারে না। মেঘনা-পদ্মার বিরাট বিভীষিকা তার মধ্যে নাই। আবার রমুমোড়লের মরাই, যদু পণ্ডিতের পাঠশালার পাশ দিয়া বহিয়া যাওয়া শীর্ণ পল্লীতটিনীর চোর কাঙ্গালপনাও তার নাই। তিতাস মাঝারি নদী।


দুষ্ট পল্লীবালক সাঁতরাইয়া পার হইতে পারে না। আবার ছোট নৌকায় ছোট বউ নিয়া মাঝি কোনো দিন ওপারে যাইতে ভয় পায় না। তিতাস শাহি মেজাজে চলে। তার সাপের মতো বক্রতা নাই, কৃপণের মতো কুটিলতা নাই। কৃষ্ণপক্ষের ভাটায় তার বুক খানিকটা শুষিয়া নেয়, কিন্তু কাঙাল করে না। শুক্লপক্ষের জোয়ারের উদ্দীপনা তাকে ফোলায়, কিন্তু উদ্বেল করে না।'
অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর 'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে এভাবেই তিতাসের রূপের বর্ণনা করেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাবেষ্টিত হয়ে আছে এই তিতাস। তিতাস নদী ছাড়া জেলার অস্তিত্ব চিন্তাও করা যায় না, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই মরে আছে তিতাস। বিভিন্ন সূত্রমতে, ভরাট হয়েছে গেছে ২১,০১২ কিলোমিটার তিতাসের প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকা। তিতাসের বুকে এখন আর মাঝি-মাল্লাকে পালতোলা নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে বেরোতে খুব একটা দেখা যায় না। এখন বর্ষায়ও চোখে পড়ে না তিতাসের চিরচেনা রূপ। তিতাসের পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। কোথাও কোথাও চোখে পড়ে জেগে ওঠা চর। বর্ষা মৌসুম শেষ হলে বন্ধ হয়ে যায় বিভিন্ন নৌরুট। শুকনো স্থানে পড়ে থাকা নৌকাগুলো দেখে মনে দাগ লাগে। তিতাসের ভরাট নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়ও কম লেখালেখি হয়নি। বছর দুয়েক আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সফরে এসে তিতাস খননের ঘোষণা দেন। সে লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও উদ্যোগ নেওয়া হয়। যদিও এর বাস্তব প্রতিফলন এখনো দেখা যাচ্ছে না।
তিতাস আবারও আলোচনায় আসে ভারতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল বহনকারী ট্রেইলর পারাপারের জন্য রাস্তা করা নিয়ে। ভার বহন করতে পারবে না বলে ব্রিজের নিচ দিয়ে তিতাসের বুকচিরে রাস্তা নির্মাণ করা হয়। এতে বন্ধ হয়ে পড়ে নৌচলাচল। বিভিন্নভাবে প্রচারণা শুরু হয় তিতাসের বাঁধে তলিয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি। অনেক কৃষক হতাশাগ্রস্ত। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর ট্রানজিটের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ঢাকা থেকে আখাউড়া পর্যন্ত লংমার্চ করে পেশাজীবী পরিষদ। ওই লংমার্চে নেতৃত্ব দেওয়া সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান তিতাসের ওপর দিয়ে যাওয়া রাস্তায় একটি প্রতীকী কোপ দেন। পরে এক জনসভা ও সফরসঙ্গীদের তিনি বলেন, তিতাসের এ বাঁধের কারণে কৃষকের হাহাকার পড়েছে। কোথাও তলিয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি। কোথাও পানির অভাবে সেচ দেওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকার কোনো উদ্যোগ না নিলে আগামীতে আরো অনেক গাড়ি নিয়ে এসে তিতাসের বাঁধ কেটে দেওয়া হবে। ওই লংমার্চের পর বিভিন্ন মিডিয়ায় এ নিয়ে নানা ধরনের প্রচারণা শুরু হয়।
বিশ্বজিৎ পাল বাবু

No comments

Powered by Blogger.