কল্পকথার গল্প-স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন ও কিছুটা দিবাস্বপ্ন by আলী হাবিব

স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃত সমান। আমরা ছাপোষা মানুষ হাঁ করে স্বপ্নের কথা শুনি। মহামহিম স্বপ্নদ্রষ্টারা করেন বয়ান। তাঁদের বয়ান শুনে আমরা আহ্লাদিত হই। বিগলিত হই। আমাদের পাকা ধানে কেউ যদি দিয়ে যায় মই, তাও আমরা স্বপ্নে বিভোর থাকি। আমাদের আইকন যাঁরা, তাঁরা আমাদের স্বপ্নের কথা শুনিয়েছেন যে। কারো কারো মতে,


সেটা দিবাস্বপ্ন। হোক। সে স্বপ্নের কথা আমাদের তাঁরা শুনিয়েছেন যে! আমরা শুনে পুণ্যবান! আহা, তাঁরা যদি না থাকতেন, আমরা স্বপ্ন দেখতাম কেমন করে। বিজ্ঞানে স্বপ্নের ব্যাখ্যা আছে। কী সব কারণে নাকি মানুষ স্বপ্ন দেখে। আমরা বিজ্ঞান বুঝি না। আমাদের জ্ঞান সীমিত। কিন্তু তার পরও আমরা স্বপ্ন দেখি। কারণ আমরা স্বপ্ন দেখতে শিখেছি। আমাদের স্বপ্ন দেখানো হয়। আমরা দেখি। দেখি আর বিভোর হই স্বপ্নে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে স্বপ্নের প্রভাব অনেক। রাস্তায় বের হলে দেখবেন, স্বপ্নেপ্রাপ্ত ওষুধ নিয়ে মজমা জমে গেছে। কোনো এক কবি স্বপ্নের ভেতর কবিতা লিখতেন। একবার তিনি লিখে যাচ্ছিলেন। বাদ সাধলেন এক বেরসিক প্রতিবেশী। অবেলায়, অসময়ে কবির বাড়িতে এসে কড়া নাড়তেই ঘুম ছুটে গেল। কবিতা ছুটি নিল। সেই অসমাপ্ত কবিতাটি আর লেখা হলো না। বিখ্যাতদের অনেক বিখ্যাত স্বপ্ন আছে। স্বপ্নের গল্প আছে। এক বিখ্যাত স্বপ্নের কথা বলা যাক। গল্পটি আব্রাহাম লিঙ্কনের।
আব্রাহাম লিঙ্কন এক রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বপ্নে তিনি দেখলেন যে তাঁর ঘরে সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা রয়েছে একটি শবদেহ। শবদেহটির চারপাশে যাঁরা ভিড় করে আছেন, সবাই তাঁর চেনাজানা। তিনি ভিড় ঠেলে সামনে গেলেন। শবদেহের ওপর থেকে চাদরটি সরাতেই চমকে উঠলেন লিঙ্কন। সাদা চাদরে আচ্ছাদিত শবটি আর কারো নয়, তাঁরই। স্বপ্নের এই ঘটনা লিঙ্কন অনেককেই বলেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান তিনি। স্বপ্নে দেখা সাদা চাদরের মতোই একটি সাদা চাদরে ঢেকে রাখা হয় তাঁর শবদেহ। চারপাশে চেনা মানুষের ভিড়।
কেমন স্বপ্ন বলবেন এটাকে? দুঃস্বপ্ন? তাহলে আরেকটা গল্পে যাওয়া যাক। এই গল্পটি এক শিল্পীর। ফসিলি নামের এই শিল্পী বীভৎস ছবি আঁকতেন। তাঁর ছবি আঁকার উৎস ছিল দুঃস্বপ্ন। ছবি আঁকার আগে তিনি দুঃস্বপ্নের সাধনা করতেন। এরপর রাতে ঘুমোতে যেতেন। ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন এসে হানা দিত। তিনি সেই দুঃস্বপ্নের ছবি আঁকতেন। স্বপ্ন কিংবা দুঃস্বপ্নের কথা থাক। অন্য গল্পে যাওয়া যাক।
জনৈক চোরের গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। কথায় আছে, 'চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ে ধরা'। আমাদের গল্পের এই চোরও সে রকম এক চোর। ওস্তাদের কাছ থেকে বিদ্যাটি বেশ ভালোভাবেই আয়ত্ত করায় কখনো বিপদে পড়তে হয়নি তাকে। কিন্তু এলাকায় তার নামডাক বেশ ছড়িয়ে পড়ে অল্প দিনেই। চোর মহোদয় এলাকায় বেশ পরিচিতি পেয়ে গেলেও চোর ধরার দায়িত্ব যাদের, তাদের নাগালের বাইরে থেকে যেতে কোনো অসুবিধা হয়নি তার। তার পরও মানুষ বলে কথা। মানুষের মধ্যে কোনো না কোনো সময় পরিবর্তন আসে। আমাদের গল্পের এই চোরের মধ্যেও একটা পরিবর্তন এলো। যেমন এসেছিল দস্যু রত্নাকরের মধ্যে। পুরাণের রত্নাকর দস্যুবৃত্তি করতেন। পথচলতি পথিকদের সর্বস্ব লুটে নিতেন। সে আমলে স্বর্গ থেকে দেব-দেবতারা মর্ত্যে আসতেন। আজকের দিনে যেমন বড়কর্তারা মফস্বলে পরিদর্শনে যান, তেমনি দেব-দেবতারা মর্ত্যে আসতেন। তো, সেই মর্ত্যে ডিউটি করতে এসেছিলেন নারদ। ওই কথায় বলে, 'পড়বি পড় মালির ঘাড়ে'- নারদ পড়লেন দস্যু রত্নাকরের সামনে। দেবতাদের তো আর ভিসা-পাসপোর্ট লাগত না। আজকের দিনের মতো সে আমলে ডলার এনডোর্স করতে হতো না। স্বাভাবিকভাবেই, নারদ মর্ত্যে এসেছিলেন খালি হাতে। টাকা-পয়সা ছিল না তাঁর কাছে। কিন্তু দস্যু রত্নাকর তো সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। তাঁকে তো কিছু দিতেই হবে। রত্নাকর নারদকে মেরে ফেলতে উদ্যত হলেন। নারদ অনেক কষ্টে নিবৃত্ত করলেন তাঁকে। বোঝালেন, রত্নাকর যেটা করতে যাচ্ছেন, সেটা পাপ। তাঁর এই পাপের ভাগ কেউ নেবে না। রত্নাকর বিখ্যাত দস্যু বলে কথা। তিনি বললেন, পরিবারের জন্যই তিনি বেছে নিয়েছেন এই দস্যুবৃত্তি। কেন পরিবারের সদস্যরা তাঁর পাপের ভাগ নেবে না? চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন নারদ। রত্নাকর গেলেন নিজের বাড়িতে। স্ত্রী-সন্তান রাজি হলেন না পাপের ভাগী হতে। এমনকি তাঁর মা জানিয়ে দিলেন, পুত্রের পাপের ভাগীদার তিনি হবেন না। রত্নাকর আগের জায়গায় ফিরে এলেন। সেখানে তাঁর অপেক্ষায় ছিলেন নারদ। তিনি নারদকে জানালেন, পরিবারের কেউই তাঁর পাপের ভাগ নিতে সম্মত নয়। নারদ তাঁকে রামমন্ত্রে দীক্ষা দিলেন। চৈতন্য হলো তাঁর। দস্যু রত্নাকর বসে গেলেন ধ্যানে। হয়ে গেলেন বাল্মীকি। লিখে ফেললেন রামায়ণ।
আমাদের গল্পের চোর অমন গুণী মানুষ না হলেও চুরি ছেড়ে দিলেন। বৈরাগ্য এসে গেল তাঁর মধ্যে। কিন্তু এবার ঘটল বিপদ। কোথাও চুরি হলেই তাঁকে গিয়ে ধরা হতো। বেদম প্রহার করা হতো। চুরি ছেড়ে দিয়ে বিপদে পড়ে যায় আমাদের গল্পের এই চোর। এমন চরিত্র আমাদের চারপাশে অনেক ঘোরাঘুরি করে। আমাদের প্রবাদ-প্রবচনে এমন অনেক কথাও পাওয়া যায়। যেমন আছে, 'যত দোষ নন্দ ঘোষ'। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো তাঁর পুরাতন ভৃত্য কবিতায় লিখেছেন এমন এক চরিত্রের কথা। 'ভূতের মতোন চেহারা যেমন, নির্বোধ অতিঘোর/ যা কিছু হারায় গিন্নি কলেন কেষ্টা বেটাই চোর।' আমাদের সমাজে ও সংসারে এমন নন্দ ঘোষ ও কেষ্টাদের দেখা পাওয়া খুব কঠিন নয়। এই কেষ্টারা অন্যের পাপের বোঝা নিজেরা বহন করেন। অন্যের দায় নিজের কাঁধে তুলে নেন। যত দোষ সব গিয়ে পড়ে ওই নন্দ ঘোষদের ওপর। কৃষ্ণ যা কিছু করেন, সব দোষ গিয়ে পড়ে বেচারা নন্দের ওপর। কেন? সূত্র ওই 'কেষ্টা বেটাই চোর'। কেষ্টা তো তেমনই চরিত্র। 'উঠিতে বসিতে করি বাপান্ত, শুনেও শোনে না কানে'। তেমনি কৃষ্ণ বোধ হয় কারো কথা শুনতেন না। যতই 'ননী চুরি আর করব না' বলে গান লেখা হোক- ননীচোরা অপবাদ তো ছোটানো যায়নি কোনো দিন।
ওসব পুরাণ তোলা থাক। আমরা আমাদের কথায় আসি। আমাদের দেশে একটা প্রবণতা সব সময় দেখা যায়। কী সেটা? দায় চাপানোর প্রবণতা। ব্যর্থতার দায় কেউ নিতে চায় না। একবার কেউ কুরসিতে গিয়ে বসলে তোষামোদ আর স্তুতি ছাড়া কিছু তাঁর কানে ঢোকে না। এটা বোধ হয় কুরসির গুণ। কেউ ব্যর্থতার কথা স্বীকার করতে চান না। সবাই নিজেদের গুণগান শুনতে পছন্দ করেন। এটা ক্ষমতার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। ক্ষমতার এই গুণটি আছে। ক্ষমতা অনেককেই 'একচোখা' করে দেয়। এর আগেও এমন দেখা গেছে। যখন দেশের কোনো সংকটে মিডিয়া সোচ্চার হয়, তখনই দেখা যায় মিডিয়ার বিরুদ্ধে কুরসিধারীরা একাট্টা হন। উদাহরণ দেওয়া যাক। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জঙ্গিবাদ, বাংলা ভাই, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও ক্রসফায়ার ইত্যাদি নিয়ে মিডিয়া সোচ্চার হলে বলা হতো- এসব মিডিয়ার সৃষ্টি। এভাবেই গণমাধ্যমের সমালোচনা করা হতো। এখন যেমন নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, বেসামাল অর্থনীতি, গুম, গণপরিবহনে নৈরাজ্য, সড়ক সংস্কারসহ সরকারের অহেতুক সমালোচনা করে অতিরঞ্জিত খবর প্রচার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। অথচ এটা কি অস্বীকার করার উপায় আছে যে দেশের অর্থনীতিতে কালো ছায়া পড়েছে। কথাটা তো অর্থমন্ত্রী নিজেই সংসদে বলেছেন। তা ছাড়া দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, দেশের অর্থনীতি সংকটে রয়েছে। সমস্যার দিকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মানুষের জীবনযাত্রার চিত্রের ওপর নির্ভর করে সব সময়ই মিডিয়া প্রতিবেদন তৈরি করে। এটা সরকারকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু এসবকে 'রাবিশ', 'স্টুপিড' কিংবা 'বোগাস' বলে তাচ্ছিল্যের কোনো সুযোগ নেই। সে আমলে দুর্বৃত্তদের গুলিতে বাবার কোলে সন্তানের মৃত্যু হলে বলা হয়েছিল, 'আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে'। এখন মায়ের হাত ধরে থাকা সন্তানের ওপর বাস উঠে গেলে বলা হচ্ছে, 'অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট'। কোথায় যাব আমরা?
স্বপ দিয়ে শুরু হয়েছিল। সেই স্বপ্ন কিংবা দুঃস্বপ্নে ফেরা যাক। এক তরুণের স্বপ্ন ছিল বৈমানিক হওয়ার। সেই গল্পে যাই। চালানোর গল্প। গাড়ি চালাতে শিখতে হয়। তেমনি বিমান চালাতেও শিখতে হয়। না শিখে কোনো কিছুই চালাতে যাওয়া ঠিক নয়। শিখতে গেলেও অনেক সময় বিপদ দেখা দিতে পারে। আমাদের গল্পের ওই শিক্ষার্থী বিমানচালকের গল্প বলা যাক। তাঁকে শেখানো হয়েছে কেমন করে বিমান থেকে লাফ দিতে হবে। কেমন করে প্যারাস্যুট খুলতে হবে। নিরাপদে নামার পর বিমানবন্দরের গাড়ি তাঁকে কোত্থেকে তুলে নেবে- সব জানানো হয়েছে। শিক্ষার্থী বিমানচালক প্যারাস্যুট নিয়ে বিমান থেকে লাফিয়ে নামার পর টের পেলেন, প্যারাস্যুট খুলছে না। তিনি দ্রুতবেগে নিচের দিকে নামতে থাকলেন। নিচের দিকে নামতে নামতে তিনি ভাবলেন, ইনস্ট্রাক্টর বাজে কথা বলেছে। এখন প্যারাস্যুট খুলছে না। এরপর হয়তো দেখা যাবে ওখানে গাড়িটাও নেই।
গাড়ি থাক বা না থাক, এভাবে পড়তে থাকলে তিনি যে নিচে পড়া মাত্র চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবেন, সেই বুদ্ধি তাঁর ছিল না। অবশ্য অনেক ওপরে উঠে যাওয়ার পর পতনের সময় আমাদের অনেকেরই হুঁশ-বুদ্ধি লোপ পায়। এটাই হচ্ছে সত্যিকারের দুঃস্বপ্ন। আমাদের যাওয়ার জায়গা নেই। কাজেই একটা গল্প বলা যাক। এক লোকের গাধা হারিয়ে গেছে। তিনি হন্যে হয়ে গাধা খুঁজে বেড়াচ্ছেন। সারা দিন ধরে খুঁজলেন। কোথাও পেলেন না। কী করবেন? শেষে সন্ধ্যাবেলা বাড়ির পথ ধরলেন। সবাই জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন, গাধাটিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু তাতেও তাঁর আফসোস নেই। কেন? ভদ্রলোক ভারি মজার একটা জবাব দিলেন। ভাগ্যিস, আমি গাধার ওপর ছিলাম না। থাকলে তো আমিও হারিয়ে যেতাম।
না, আমরা হারিয়ে যাব না। গাধা হারিয়ে যায় যাক।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.