মহাজোট সরকার কী কী পারে by আফরোজা হাসান খান

হাজোট সরকার কী কী পারে, আর কী কী পারে না এরকম একটা বিষয় আমার মাথায় ধরা পড়ছে। যেমন বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান দ্রব্যমূল্য না বাড়ানোর জন্য সব শ্রেণীর ব্যবসায়ীর উদ্দেশে হুশিয়ারি দিয়েছিলেন। আমরা, মানে ভোক্তাশ্রেণী খুশিতে ডগমগ, এইবার দাম বাড়াতে পারবে না বাজারি সিন্ডিকেটরা। ব্যস! বাণিজ্যমন্ত্রীর ঘোষণাও শেষ, আর বাজারে কাঁচা-পাকা পণ্যের দাম বাড়াও শুরু হলো।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-তোমার হলো শুরু আমার হলো সারা। বাণিজ্যমন্ত্রীর মনের ভেতরে এই রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়তই বেজে চলেছে, থামার কোনো লক্ষণ নেই। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, মহাজোট সরকার যেখানেই হাত দিচ্ছে সেখানেই এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। একে কি আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মতো ষড়যন্ত্র বলব? তিনি প্রায়ই বলেন, আপনারা সজাগ থাকেন, এ নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ষড়যন্ত্র কে করছে তা কিন্তু তিনি বলছেন না। ইঙ্গিতের শেষ মাথায় অবশ্য বোঝা যায় ষড়যন্ত্রকারীরা হচ্ছে বিএনপি। কারণ তাদের নেতা-নেত্রীরা এখনও প্রকাশ্যে আওয়ামী মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলেনি। প্রকাশ্যে আন্দোলন না থাকলে অবশ্যই গোপন ষড়যন্ত্র আছে! বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিন ১৫ আগসট; তাই ওইদিন আর কোনো মানুষের জন্মদিন হতে পারবে না। আর বিএনপিকেও বলিহারি এইরকম একটি দিনে [জাতীয় শোক না উৎসব! বোঝা কঠিন] বিএনপি নেত্রীর জন্মদিন পালন করেন তারা। তবে বোঝা যায়, জন্মদিন পালন করেন তারা জাতীয় শোকের মতো করে, যাতে কেউ টের না পায়! যা হোক, সরকারের যে মন্ত্রী যে কাজে হাত দেন, দেখা যায় সেখানে সোনার বাংলা গড়ে তোলার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। বাণিজ্যমন্ত্রী সেটা টের পেয়েছেন। এবার বাণিজ্যমন্ত্রীর পথ ধরেছেন যোগাযোগমন্ত্রী মহোদয়। তিনি বলেছেন, এবার ঈদে ঘরেফেরা যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করলে রুট পারমিট বাতিল করে দেবেন। এর আগেও ডিজেলচালিত বাসের মালিকরা সরকারের নির্দেশ অমান্য করে বাড়তি ভাড়া আদায় করে চলেছে। সেই ক্ষোভ তো সরকার ভুলে যায়নি। এবার বাড়তি ভাড়া আদায় করলে খবর আছে! শুধু এটুকুই না, সরকার গত ৩১ আগসট থেকে ঢাকা মহানগরে চলাচলকারী ২০ বছরের পুরনো প্রাইভেট কারসহ অন্য ৭০ হাজার গাড়ি রাস্তা থেকে তুলে নেবে। এটা সরকারি প্রতিজ্ঞা। আমার বিশ্বাস, সরকার এখানেও ব্যর্থ হবে। প্রথমত ওই ৭০ হাজার গাড়ির মালিকদের মধ্যে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের সংখ্যা নিতান্তই কম হবে না। তারা ক্ষুব্ধ হলে খবর আছে। এছাড়া আওয়ামী মহাজোটের শরিকরা কি বসে থাকবে? তাদের অনেক নেতাকর্মীরও আছে লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহন। তারাও এর প্রতিবাদ করবে। এজন্য বলছি, যোগাযোগমন্ত্রী বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধ এবং রাজধানীর সড়ক থেকে ৭০ হাজার গাড়ি তুলে নিতে পারবেন না। তিনি ব্যর্থ হবেন। তবে, আমি বা আমরা যারা সরকারের ভালো চাই, দেশের ভালো চাই, নিয়তই সরকারের সমালোচনায় মগ্ন থাকি, তারা চাই সরকার যে পদক্ষেপটি নিয়েছে তা জনহিতকর, অতএব তা বাস্তবায়িত হোক। হোক বললেই তো আর হয়ে যায় না। তাই অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের দিকে চেয়ে থেকে। দেখা যাক, যাত্রী পরিবহনে গাড়ির মালিকরা যাত্রীদের পকেটের বাড়তি টাকা নিতে পারে কি পারে না। এবার রাজধানীর সড়কপথগুলোর ব্যাপারে আসা যাক। অপারেশন ক্লিন সিট্রট কি এখনও চলছে? সেটা রাজধানীর মানুষ বুঝতে পারছে না। দৈনিক যুগান্তর বলেছে, ক্লিন সিট্রট অপারেশন চললেও সিট্রটগুলো ক্লিন হচ্ছে না। সোমবারও নগরীর বিভিন্ন সড়কে দিনভর যানজট ছিল। আর ভ্রাম্যমাণ আদালত অন্যান্য গাড়ি রেখে কেবল প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস আটক করতেই সময় কাটাচ্ছে। এতে হয়তো কয়েক হাজার মহাজোটীয় সমর্থক ক্ষুব্ধ হবে, কিন্তু তাদের পুষিয়ে দেয়া যাবে দলীয়করণের নানা কর্মসূত্রে। কিন্তু লক্কড়-ঝক্কড় গাড়িগুলোর মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তারা রাজধানী অচল করে দেবে। তখন তাদের সামলাতে নামাতে হবে পুলিশ। আর পুলিশ নামানো মানেই সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষ আর দেখতে চায় না কেউ। না, এখানেও কপালে ব্যর্থতাই লেখা আছে যোগাযোগমন্ত্রীর। কী করে একথা অকপটে বলতে সাহসী হচ্ছি আমি বা আমরা? কারণ আমাদের রয়েছে সমৃদ্ধ ব্যর্থতার উত্তরাধিকার। আমরা স্বাধীনতার ৩৭ বছরে যতটুকু এগিয়েছি, তার মাসুল কিন্তু গুনতে হয়েছে অনেক বেশি। আমি কোনো দেশের নাম করতে চাই না, আপনারা খুঁজে দেখেন যেসব দেশ আমাদের চেয়ে দরিদ্র ছিল তাদের উন্নতি আমাদের চেয়ে বেশি হয়েছে কি-না। আরও একটি বিষয় আছে। রাজধানীর যানজট সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিরসন করতে পারবে কি-না। সরল ভাষায় উত্তর হবে-পারবে না। কারণ, আইন অনুযায়ী বাণিজ্যিক এলাকার ভবনগুলোর নিচতলা গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রাখতে হবে। আমি দিলকুশা-মতিঝিল এলাকার কোনো ভবনের নিচতলায় গাড়ি পার্কিং করতে দেখিনি। আমার নজরের বাইরে দু'চারটি ভবনে গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা থাকতে পারে। এই এলাকার গাড়ি পার্কিংগুলো পরিণত হয়েছে দোকান কিংবা অফিসে। ফলে হাজার হাজার অফিসারের গাড়ি রাস্তার ওপর পার্কিং করা হয়। আর যানজটের প্রধান কারণ এটাই। এখন বাণিজ্যাধিপতিদের এসব অফিস, দোকান তুলে দেয়ার কথা সরকার জোর গলায় বলছে। যদি না তোলে, তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। মাফ করবেন, এই আইনানুগ ব্যবস্থা টার্মটি এদেশে অত্যন্ত ভেক টার্ম। কারণ সরকার আইনানুগ ব্যবস্থা না নিতে নিতে এটি এখন ভোঁতা হয়ে গেছে এবং এই ধমকিতে কেউ আর ভয় পায় না। ভয় পাবে কেন? উচ্চপদস্থ আমলা আর নিম্নপদস্থ কামলাদের সম্মিলন আর রাজনীতির শাসকদের দুর্নীতি তো আছেই। মতিঝিল-দিলকুশার ভবনগুলোর মালিকরা সরকারের এই ভালো ইচ্ছাকে ভেংচি দিতে রেডি হচ্ছে। এদের প্রভাবমুক্ত হতে পারলে তো সোনায় সোহাগা। আমরা চাই, আমরা মানে গাড়ি যাদের নেই, কিন্তু নিয়তই গাড়ির চড়নদার, আমরা চাই বাণিজ্যিক এলাকা যানজটমুক্ত হোক। শুধু কি ওইটুকু চাই? আমরা চাই গোটা মহানগরই যানজটমুক্ত হোক। চাই মহানগর থেকে পুরনো গাড়িগুলো বিদায় নিক। কিন্তু আমরা চাইলেই যদি সব হয়ে যেত, তবে এত কথা লেখার প্রয়োজন পড়ত না। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের সংযত হয়ে কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ভুলে গেছেন, আমরা কথায় ওস্তাদ। ওয়াদা দিয়ে তা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে আমাদের যে 'ঐতিহ্য' রয়েছে, তার তুলনা পৃথিবীর কম দেশেই আছে। সেখানে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপদেষ্টাদের সংযত থাকার নির্দেশে কোনো কাজ হবে না। আমরা কেবল 'সং' সাজতে 'যত' ভালোবাসি, ততটা সংযত হতে নয়! অতএব, আমরা সংযত হতে পারব না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর এইচটি ইমামের মধ্যে যে চ্যালেঞ্জ চলছে, তা কি প্রমাণ করে না যে, প্রয়োজনে নিজের ক্ষতি করে হলেও অন্যের যাত্রাভঙ্গ করাই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি!

No comments

Powered by Blogger.