বিডিআর বিদ্রোহের মতো আরও ঘটনা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি by ড. মাহবুব উল্লাহ্

ত ১৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ ঘোষিত 'দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস' উপলক্ষে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে আনীত একটি প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করার ষড়যন্ত্র এখনও চলছে। বিডিআর বিদ্রোহের মতো ঘটনা আবারও ঘটতে পারে।
অনেক লড়াই-সংগ্রাম করে পুনরুদ্ধার করা গণতন্ত্র কোনো বিশেষ মহল যাতে নস্যাৎ করতে না পারে, সে জন্য সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। পবিত্র সংসদের মেঝেতে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাকে অবশ্যই দেশের সজাগ ও সচেতন মহলকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। কারণ, প্রধানমন্ত্রী মেঠো রাজনৈতিক ভাষণ দিতে গিয়ে একথা বলেননি, বলেছেন সংসদে দাঁড়িয়ে। যে বক্তব্য সংসদের ফ্লোর থেকে আসে, তাকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, মনে রাখা দরকার তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। দেশের তাবৎ গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট তাঁর গোচরে আসে। এ কারণে সাধারণ মানুষ যে তথ্য পায় না, প্রধানমন্ত্রী সে তথ্য পান। এছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে বহু সূত্র থেকে তাঁর তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ থাকে। এদিক থেকেও প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান যে কোনো সাধারণ নাগরিক, এমনকি তার মন্ত্রীদের চেয়েও অনেক বেশি সুবিধাজনক। কাজেই প্রধানমন্ত্রী যে গুরুতর বক্তব্য দিয়েছেন তা কিছুতেই হেলাফেলা করার মতো নয়। তথ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর যেমন বিশেষ সুবিধে রয়েছে, তেমনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ফলে তার জন্য ওহভড়ৎসধঃরড়হ ইষধপশড়ঁঃ-র বিপত্তিও থাকে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'রাজার মত সাজাও যারে/ পরাও রতন মানিক হার/ বসন ভূষণ হয় যে বেজায় ভার।' দেশের প্রধানমন্ত্রী সাধারণ মানুষ নন। ইচ্ছে করলেই যখন-তখন তিনি সাধারণ মানুষের সংসপর্শে আসতে পারেন না। এমন কি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদিতে যখন তিনি আসেন, প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেন, তখনও তিনি ওইসব বাছাই করা শ্রোতার কাছ থেকে দূরে উঁচু মঞ্চে অবস্থান করেন। কাজেই মতবিনিময়ই বলুন আর ভাববিনিময়ই বলুন তার সুযোগ কোথায়? এভাবেই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীরা বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের বাসিন্দায় পরিণত হন। রাষ্ট্রাচার তাদের ভিনগ্রহের মানুষে পরিণত করে। হ্যাঁ, এসব বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর একটি বিশেষ সুবিধা রয়েছে। তিনি কূটনৈতিক সূত্রেও কিছু তথ্য পেয়ে থাকেন। যেসব রাষ্ট্রের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা থাকে, তারাও তাদের গোয়েন্দা সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য প্রয়োজন মনে করলে প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে পারেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনারও নজির আছে। অ্যান্হনি ম্যাসকারেনহাস জানিয়েছেন, একবার রাষ্ট্রপতি জিয়ার বিরুদ্ধে একটি ভয়াবহ ক্যু'র ষড়যন্ত্র হয়েছিল; কিন্তু সেই ষড়যন্ত্রের খবর দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানাতে পারেনি। রাষ্ট্রপতি জিয়াকে সেই তথ্য জানিয়েছিল মিসরীয় গোয়েন্দা সংস্থা। মিসরীয় গোয়েন্দা সংস্থাটি নিজস্ব সূত্রে এই তথ্য পেয়েছিল অথবা অন্য কোনো সূত্রে পেয়েছিল, তা আমরা জানি না; তবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে পারসপরিকভাবে তথ্য বেচাকেনার রীতি প্রচলিত আছে। সেই সুবাদে এক দেশের গোয়েন্দা সংস্থা অন্য দেশের গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে থাকে। যাই হোক, মিসরীয় গোয়েন্দা সংস্থাটির বিশেষ উদ্যোগের ফলে রাষ্ট্রপতি জিয়া সেই অভ্যুত্থানটির বিপদ থেকে রক্ষা পান। কথিত আছে, রাষ্ট্রপতি জিয়ার সময় তাকে উৎখাত করতে ২১টি ক্যু চেষ্টা চালানো হয়েছিল। এর মধ্যে সর্বশেষ প্রচেষ্টায় রাষ্ট্রপতি জিয়া নিহত হন। আমার কাছে আজও রহস্যময় মনে হয় রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ১৯৭৫-র ১৫ আগষ্ট যে ভয়াবহ অভ্যুত্থান হয়, সে সম্পর্কে তিনি বিন্দুমাত্র অাঁচ-অনুমান করতে পারেননি। যদি সামান্যতমও অাঁচ-অনুমান তিনি করতে পারতেন, তাহলে হয়তো ওই ট্র্যাজিক ঘটনাটি এড়ানো সম্ভব হতো। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র' বাংলাদেশের ঘটনাবলীর ওপর তীক্ষ্ন নজর রাখে বলেই অনেকের ধারণা। শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার ভারত সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিল বলেই একটি ধারণা প্রচলিত আছে। আমাদের প্রশ্ন, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাটি কি শেখ মুজিবুর রহমানকে সাবধান করার সুযোগ পায়নি? এ থেকে অনুমান করা যায়, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোকে সব ব্যাপারে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না, তারা যতই বন্ধুভাবাপন্ন হোক না কেন। শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে তৎকালীন ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর মূল্যায়ন খুব ইতিবাচক ছিল না। এ ব্যাপারে বিশদ জানা যায় জে. এন. দীক্ষিত রচিত খরনবৎধঃরড়হ অহফ ইবুড়হফ গ্রন্হ থেকে। আসলে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত এমন একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র যে রাষ্ট্রটি বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা জিইয়ে রাখতে পছন্দ করে। এতে করে ভারতের পক্ষে সরকার নির্বিশেষে সব সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার সুযোগ থাকে, যাতে করে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে করিডোর, বন্দর, সমুদ্রসীমা, পানিবণ্টনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফায়দা ওঠাতে পারে। পিতার অভিজ্ঞতা থেকে পুত্রী শেখ হাসিনা যদি এসব বিষয় বিবেচনায় রাখেন তাহলে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ অনেক সহজ হবে। বিডিআর বিদ্রোহের মতো আরও ঘটনা ঘটানোর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন তাকে হালকাভাবে নেয়া যায় না। বিডিআর বিদ্রোহের ফলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তার ওপর চরম আঘাত এসেছে। চক্রান্তকারীরা দেশি হোক আর বিদেশি হোক, 'এক ঢিলে দুই পাখি' মেরেছে। একদিকে তারা বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়েছে, যেটি পুনর্গঠন করতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী এবং সাহসী একটি নিরাপত্তা বাহিনী। অন্যদিকে এই বিদ্রোহের ফলে সামরিক বাহিনী হারিয়েছে ৫৭ জন চৌকস সামরিক অফিসার। এদের মর্মান্তিকভাবে হত্যা করা হয় এবং এদের পরিবারের সদস্যদেরও বর্ণনাতীতভাবে নিগৃহীত করা হয়। এতে করে সামরিক বাহিনীর মনোবলের ওপর যে আঘাত এসেছে সেই আঘাত কাটিয়ে ওঠা সত্যিই কঠিন হবে। এই ঘটনার ফলে কারা লাভবান হবে তা অনুমান করা কঠিন নয়। তবু তাদের প্রতি আমাদের দুর্বলতা যেন কাটছে না। আজ পর্যন্ত আইনি মারপ্যাঁচের ধূম্রজালের ফলে বিডিআর বিদ্রোহের বিচার শুরু করা সম্ভব হয়নি। ঘটনাদৃষ্টে মনে হয়, বিডিআর বিদ্রোহের বিচার হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে বৃহত্তম 'গ্যাং কেস'। যারা আইন-আদালত সম্পর্কে জানেন, তাদের এ কথা অজানা নয় যে, গ্যাং কেসের বিচার দীর্ঘস্থায়ী হয়। এর ফয়সালা সহজে হওয়ার নয়। বিচারে দীর্ঘসূত্রতার ফলে সামরিক বাহিনীর মনোবলের ওপর তীব্র নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সর্বোপরি এ ঘটনার যতটুকু তদন্ত হয়েছে তাতে ঘটনার পেছনে দেশি-বিদেশি নেপথ্য নায়কদের শনাক্ত করার চেষ্টা করা হয়নি। কাদের রক্ষা করার জন্য তদন্তে এ রকম ফাঁক রাখা হয়েছে, সেটি এক বিরাট জিজ্ঞাসা। এ কারণেই বিডিআর বিদ্রোহের মতো আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটানোর জন্য ষড়যন্ত্রকারীরা সাহস পাচ্ছে কিনা সেটাই আজ প্রধানমন্ত্রীর কাছে জিজ্ঞাস্য। বাংলাদেশ আর কোনো ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের চাপ সহ্য করার শক্তি রাখে না। প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগটি যদি সত্য হয় এবং ষড়যন্ত্রকারীরা যদি খোদা না করুক সফল হয় তাহলে রক্তস্রোতের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে আমরা হারাতে পারি; কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এরকম একটি ঘটনা কোনোক্রমে আবারও ঘটুক তা কখনও চাইতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের ওপর হুমকির কথা বলেছেন। গণতন্ত্র অত্যন্ত মূল্যবান। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু গণতন্ত্রের চর্চা হয় দেশকে ঘিরে। দেশেরই যদি অস্তিত্ব না থাকে তাহলে গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ কোথায়? এছাড়া বিডিআর বিদ্রোহের মতো ভয়াবহ ঘটনা যদি আবারও ঘটে তাহলে হয়তো গৃহযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবে। আর গৃহযুদ্ধ মানেই তো রাষ্ট্রের অস্তিত্বের মর্মমূলে আঘাত। প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে যে ভয়াবহ ঘটনার ইঙ্গিত দিয়েছেন সে সম্পর্কে জানার অধিকার জাতির রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে জাতির প্রত্যাশা, তিনি এই সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে জাতিকে সবিস্তারে অবহিত করবেন। জাতিকে অন্ধকারে রেখে যদি কোনো বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে যায়, তাহলে জাতি এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকেই দুষবে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে কোনো ভয়াবহ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জাতিকে আগাম জানালে ঘটনার পুনরাবৃত্তি পরিহার করা যেমন সম্ভব হবে তেমনি জাতীয় ঐক্য জোরদার করার সম্ভাবনাও অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে কী এমন তথ্য আছে তা আজ জাতি জানতে চায়। অন্ধকারের গহ্বরে নিমজ্জিত থেকে, সমূহ বিপদের বিরুদ্ধে অসংগঠিত থেকে জাতি দুর্যোগের মধ্যে নিপতিত হতে চায় না। লেখক : অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট ষ্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.