রাজনৈতিক সুবাতাস কি বইবে? by আফরোজা হাসান খান

রাজনীতিতে একটা সুবাতাস বয়ে গেছে দিনকয়েক আগে, সামরিক বাহিনীর দেয়া ইফতার মাহফিলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এক টেবিলে বসে ইফতার করেছেন। শুধু ইফতার করেননি তারা, পরসপরের মধ্যে কুশল বিনিময়ও করেছেন। শেখ হাসিনা সংসদে যোগ দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন বেগম জিয়াকে। তিনি সংসদে যোগ দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টির কথা বলেছেন।

দুজনই হেসে কথা বলেছেন। আমরা সেই দৃশ্য ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেখেছি। পরের দিনের সংবাদপত্রেও দেখেছি সেই ছবি। এতে আমরা খুশি। কারণ, তাদের আচরণের জন্য আমরা মনে করি, এরা পরসপরের শত্রু। শত্রুর সঙ্গে কথা বলা, কুশল বিনিময় করা শুভ লক্ষণ। এই শুভটাই আমরা চাই। তাই আমরা খুশি, একে মহাখুশিও বলতে পারেন। এখন যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে একজন অন্যজনকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নেয়ারই কথা। আমাদের ভাবনাকে তুচ্ছ করে দিয়ে তারা হাস্যমুখে কুশল বিনিময় করে আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বোধে, শত্রুতা জিইয়ে রেখে হলেও এক ধরনের আশার সঞ্চার করেছেন। আমরা ভাবি, এই দুই নেত্রী পরসপরের মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করলেই দেশের লাভ। আর না করলে ক্ষতি। তার মানে এরা শত্রু থাকলে আমরা যারা পার্টিজেন, তাদের লাভ। এই যে আমাদের লাভ, অর্থাৎ বিএনপি আর আওয়ামী লীগের লাভ-এই লাভ বিষয়টিই আমাদের প্রধান শত্রু। কারণ, এ থেকেই এই দুটি দল পরসপরের বিরুদ্ধে শত্রুতা জিইয়ে রাখে। প্রিয় পাঠক, লক্ষ্য করুন, টিপাইমুখ বাঁধ হলে বিএনপি বলেছে বাংলাদেশ স্রেফ মারা পড়বে। আর আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রী এবং মন্ত্রীরা বলেছেন, বাঁধ হলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। ঠিক বিপরীত মেরুতে এ দুটি দলের মানসিক ও রাজনৈতিক অবস্থান। প্রকৃত এক্সপার্টরা কিন্তু বলেছেন ওই বাঁধ নির্মিত হলে ভাটির বাংলাদেশ কেমনতর ক্ষতির মধ্যে পড়বে। সংসদ সদস্যদের একটি প্রতিনিধিদল পাঠানো হয়েছিল দিল্লিতে, তাদের টিপাইমুখে নিয়েও গিয়েছিল দিল্লি সরকার, কিন্তু বৈরী আবহাওয়া তাদের নিচে, মাটিতে নামতে দেয়নি। ফিরে এসে সেই প্রতিনিধিদলের নেতা আবদুর রাজ্জাক বললেন, আমরা লাভবান হব। আমরা লাভবান হব কথাটা দিল্লি সরকারের, সেটা আবদুর রাজ্জাকের গলায় মানায় না। 'মামায় কইছে দিবো'-এমন আশ্বাসে নেচে না ওঠাই ভালো। আবদুর রাজ্জাকের এই দিল্লি-বশংবদ ভাষ্য শুনে আমরা লজ্জিত হয়েছি। লজ্জা পাননি আবদুর রাজ্জাক ও আওয়ামী লীগ। কারণ তারা মনে করে, ৩৮ বছর আগে দিল্লি সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যে সাহায্য-সহায়তা দিয়েছিল, সেই ঋণ শোধ করতেই টিপাইমুখসহ অন্যান্য বিষয়ে একটি পারসপরিক প্যাকেজ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা যায়। সেই ঋণ শোধ করতে বেরুবাড়ি ইউনিয়ন ছেড়ে দিয়ে সামান্য তিন বিঘা পরিমাণ জায়গা চেয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, বন্ধু রাষ্ট্র ভারত সরকার সেটুকু ভূমি আজও দেয়নি পুরোপুরিভাবে। ৩৮ বছরেও ভারত সরকার অভিন্ন সীমান্ত সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করেনি। ছিটমহলগুলো নিয়ে একবারও আলোচনায় বসেনি। তারা আমাদের দ্বীপ দক্ষিণ তালপট্টি নীরবে দখল করে রেখেছে। এরকম হাজারো সমস্যা-সংকটের যারা হোতা তারা যদি বন্ধু দেশ হয়, তাহলেও তারা সৎপ্রতিবেশী নয়। একাত্তরে পাকিস্তানিদের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে ভারত আমাদের যে সাহায্য দিয়েছিল, তার জন্য আমরা চিরকৃতজ্ঞ। কিন্তু সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ যদি ট্রানজিট দিয়ে করা হয়, তাহলে তা হবে চরম অন্যায়। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, যারা জীবন দিয়েছেন দেশের জন্য-তাদের ঋণ পরিশোধ করা হয়নি। আসলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্যের পেছনে ছিল অন্য অনেক কারণ। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন চেয়েছিল বলেই ভারত ওই সাহায্যে এগিয়ে আসে। আর নকশালবাড়ির সশসত্র আন্দোলনকারীদের হাতে চলে যাচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অসত্র। সেটা ঠেকা দিতেই তড়িঘড়ি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ভারত সরকার, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর। আমরা একটি অপরিণত মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে লাভ করি স্বাধীনতা। ভারতীয় সামরিক বাহিনী আজও ১৬ ডিসেম্বর পালন করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জনের গৌরবে। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে বিষয়টা। এই ভারত সরকারকে আওয়ামী মহাজোট সরকার দিচ্ছে এশিয়ান হাইওয়ের নামে ট্রানজিট, দিতে চাইছে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের অধিকার, ভারত দেবে বিদ্যুৎ [মাগনা নয়] আর আমরা দেব পরিবহন সুবিধা। বেনাপোল দিয়ে ঢুকবে, যন্ত্রপাতি নিয়ে যাবে তামাবিল সীমান্ত দিয়ে। সেই যন্ত্রগুলো কি ইন্ডাসিট্রয়াল মেশিনারিজ নাকি অসত্র-শসত্র, সেটা আমরা কেমন করে চেক করব? ভারত দেবে নেপাল আর ভুটানে পণ্য পরিবহনের সুযোগ-সুবিধা। নেপাল-ভুটান কেন নেবে পণ্য বাংলাদেশ থেকে? যদি তার চেয়েও সস্তায় তারা পায় ভারত থেকে? পাঁচ টাকার সুবিধা পাওয়ার লোভে পড়ে সরকার পাঁচ কোটি টাকার সুবিধা দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। একেই বলে দেশের স্বার্থ। দেশের স্বার্থের চেয়ে স্বাধীনতার ঋণ পরিশোধ আওয়ামী শাসকদের কাছে প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ। ২. চিনির কথা না লিখলে জিহ্বায় তিতা লেগে থাকবে। পেঁয়াজের ঝাঁজ যেমন বেড়েছে, তেমনি কাঁচামরিচের ঝাল, আর চিনির মিষ্টি হয়ে গেছে তিতা। বাজারে চিনির দাম ৬০-৬২ টাকা। আমি কিনেছি ৬০ টাকায়। মিল গেটে চিনি বিক্রি হচ্ছে ৩৯ টাকায়। ওই টাকায় গরিব মানুষ চিনি কিনতে পায় না। কোন পত্রিকায় জানি পড়লাম, এর মধ্যেই চিনির আমদানিকারক আর পাইকার আর খুচরো দোকানিরা ১২শ' কোটি টাকা ক্রেতাদের পকেট থেকে নিয়ে গেছে। একে মহাআনন্দের কথাই বলতে হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী রোজার আগেই হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, চিনির দাম ৪২ টাকার ওপরে গেলে ব্যবসায়ীদের তিনি দেখে নেবেন। এফবিসিসিআই'র সভাপতি আর কর্মকর্তাদের নিয়ে [সেই যাত্রায় কি চিনি আমদানিকারকরা ছিলেন সঙ্গে?] তিনি কাঁচাবাজারে তদারকি করে গেলেন। তিনি শুনে গেলেন দাম-দর ঠিক আছে। তিনি সামনে এগোতেই বিক্রেতারা বলে উঠলেন-বাহ! বেশি দামে কিনে উনার দামে বেচমু? উনারে চিনি বেচতে বলেন গা? বাণিজ্যমন্ত্রী ভেবেছিলেন তিনি বললে, সহযোগী এফবিসিসিআই কর্তারা বললে দাম বাড়ায় এমন সাহস কার? সাহসীরা কিন্তু সেটা দেখিয়ে দিয়েছে। মন্ত্রীর ঠিক করে দেয়া ৪০-৪২ টাকায়ও চিনির দাম রাখতে পারেননি। তার আগে চিনির দাম ছিল ৩৬-৩৭ টাকা। মন্ত্রীর হুঙ্কারে এক লাফে ৩-৪ টাকা বাড়ায় দোকানিরা। দাম বাড়ানোর অপরাধে কোনো দোকানদার কিংবা আমদানিকারককে তো অপরাধী সাব্যস্ত করতে দেখা গেল না? দিন দশেক ধরে বাণিজ্যমন্ত্রীর গলার আওয়াজ পাচ্ছি না। তিনি কেন এখন চুপচাপ? তবে তার ব্যবসায়ী বন্ধুরা সবাক। এফবিসিসিআই'র সভাপতি আনিসুল হক, তার সহযোগী সমভিব্যহারে কাঁচাবাজার পরিদর্শনে বেরিয়েছিলেন। কাঁচাবাজার ও পাকাবাজারে গিয়ে তো তার চক্ষু চড়কগাছ! চিনির দাম আকাশছোঁয়া! ক্রেতারা কিনবে কেমন করে? তার বিস্ময় কমে না কিছুতেই। কী করে এত দাম হলো? সব পত্রিকাই লিখেছে চিনির সরবরাহ যথেষ্ট বাজারে। সমকাল লিখেছে, এত চিনি যায় কোথায়? ভিনদেশে পাচার হয়? সেটাও হতে পারে। আমাদের তেমন ঐতিহ্য তো আছে। জাপানি ইলেকট্রনিকস পণ্য বাংলাদেশ থেকে এককালে ভারতে পাচার হতো। ভারতে তখন বিদেশি পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ ছিল। এখনও পাচার হয়, তবে তা ইলেকট্রনিকস পণ্য নয়, জ্বালানি তেল। ডিজেল, অকটেন আর পেট্রল এখনও ভারতের চেয়ে আমাদের দেশে দাম অনেক কম। তরল পদার্থ যেমন নিচের দিকে গড়ায়, এই জ্বালানিও সেরকম গড়িয়ে যাচ্ছে। ৩. 'রাজনৈতিক বিবেচনায় তারেক ও কোকোর মামলা প্রত্যাহার করা হবে না'-স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী টুকুর এই ঘোষণার পর মনে হলো, তাহলে সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা সব মামলাই ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, আর বিএনপিসহ চারদলীয় জোটের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়নি, সেগুলো দুর্নীতির জন্য করা হয়েছে। এখন এই সরকারের ডিজিটাল বিজয়ের অন্তর্নিহিত কারণ বোঝা যাচ্ছে। মাইনাস-টু ফর্মুলার হোতারা যে ওয়ান মাইনাসের [বেগম জিয়াকে দেশত্যাগে বাধ্য করার] লক্ষ্যে একযোগে কাজ করেছে, তা এখন হলফ করে বলা যায়। আর তারেককে শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু করার জন্য চালানো হয় নির্যাতন। মেধাবি তারেক বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নেতার আসনে যাতে আসতে না পারে, ষড়যন্ত্রটি ছিল সেরকমই। দল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে ফায়দা লোটার ষড়যন্ত্রটি এদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, শেখ হাসিনা মেয়ে ও ছেলের কাছে যাওয়ার পথে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ক্ষমতায় যেতে পারলে তিনি মইন উ আহমেদের নেয়া সব পদক্ষেপ সংসদে পাস করে নেবেন। ডিজিটাল বিজয়ের রূপরেখা সেই সময়ই রচিত হয়েছিল। শেখ হাসিনাকে আটক করার পেছনে ছিল খালেদা জিয়াকে আটক করার ফন্দি। আরও কত নাটক যে সাজানো হয়েছিল, তারই এক অংশ কোকোকে অর্থ পাচারকারী হিসেবে প্রতিপন্ন করা। বিএনপি আমলে দুর্নীতি হয়েছে, দলীয়করণও হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো নয়। তারা একজন স্কুল শিক্ষককে সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক পদে বসিয়েছে। একজন সাংবাদিককেও বসিয়েছে ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্বে। এ থেকেই বোঝা যায় সরকারি ব্যাংকে দুর্দশা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে। দখল, টেন্ডারবাজি ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের প্রধান পেশা এখন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সভাপতির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ছাত্রলীগের কাজ টেন্ডারবাজি করা নয়, পড়াশোনা করা। কিন্তু তারা তার কথা শুনছে না। টেন্ডারবাজ ছাত্রদের পুলিশ ধরছে না,র্ যাবও গায়ে হাত দিচ্ছে না। কারণ নাকি উপরের মৌখিক নির্দেশ আছে না ধরার। তবে এটা অস্বীকার করেন মন্ত্রী-নেতারা। তাহলে কোন সাহসে ছাত্রলীগের ছেলেরা ওইসব বদ-কাজ করছে এবং প্রধানমন্ত্রীর ভাবে-ভরা মূর্তিকে ধসিয়ে দিচ্ছে। আসলে ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজদের প্রশ্রয় দেয় থানার পুলিশ অফিসাররা। ঢাকা মহানগরের অধিকাংশ থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার সাবেক ছাত্রলীগ ক্যাডার। এরাই সহায়তা দিচ্ছে তাদের উত্তরসূরি টেন্ডারবাজদের। এদের সরিয়ে দিয়ে নিজেরা পুলিশকে আইন প্রয়োগ করতে বলুন, দেখেন কটা টেন্ডারবাজ সক্রিয় থাকে। তখন কিন্তু বলা যাবে না, আমাদের সোনার ছেলেদের মিথ্যা মামলায় জড়াচ্ছে পুলিশ। আমরা জানি, এটা কখনোই হবে না, বা করবেন না সরকারপ্রধান।

No comments

Powered by Blogger.