কাছে থাকুন by ফ্লোরা সরকার

গ্রামীণফোনের অ্যাডের শেষে একটি সুন্দর কথা থাকে-'কাছে থাকুন'। লেখাটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রিয় মানুষের প্রিয় চেহারাগুলো ভেসে ওঠে। আর এই ছোট্ট কথাটা শুধু গ্রামীণফোনের নয়, যে কোনো মোবাইল কোম্পানির মনের কথা। আমাদেরও। কিন্তু কাছে থাকতে গিয়ে আমরা যে ক্রমেই সবাই সবার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি, এটা কি কখনও দেখি বা অনুভব করি? প্রশ্নটা শুধু বিব্রতকরই নয়, অনেকেই একমত হবেন না।
উল্টো মনে মনে বলবেন, মোবাইলের এই দ্রুত যোগাযোগের সময় এ কী কথা শুনি? হাতের কাছের এ ছোট্ট যন্ত্রটি দিয়ে এখন আমরা যখন-তখন যে কোনো জায়গায় যে কারোর কাছে মুহূর্তে চলে যাচ্ছি, শুধু বোতামটা টিপ দিলেই হয়। অতীতে কাছে থাকার এত সহজ মাধ্যম কি কখনও ছিল? সব কথা মেনে নেয়ার পরও মনে না নিতে পারার কারণেই আজকের এ লেখা। তাই আবারও বলতে হচ্ছে, আমরা যত কাছে থাকছি বলে দাবি করে যাচ্ছি, ততই সবাই সবার কাছ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছি। তার কিছু নমুনা আমরা এ নিবন্ধটি পড়তে পড়তেই পেয়ে যাব। কিছুদিন আগেও শুনতাম যে যত তথ্য তার পকেটে জমা করতে পারবে, সৌভাগ্যের সিঁড়ি বেয়ে নয়, লিফটে চড়ে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে উঠে যাবে সৌভাগ্যের স্বর্গরাজ্যে। আমাদের কম্পিউটারে হাজার হাজার তথ্য প্রতিদিন সযত্মে জমা করে রাখি, কী জানি কখন কোন্ তথ্য কী কাজে লাগে? প্রতিদিন পত্রিকার পাতা থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক মিডিয়া, ইন্টারনেটসহ আরও নানা মাধ্যমের নানা ধরনের তথ্য আপডেট করে রাখতে হয়। কী জানি কখন কোন তথ্য কী কাজে লাগে? এভাবে তথ্য রাখার অভ্যস্ততায় এখন আমরা পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনেও শুধু তথ্য এবং তথ্য রাখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আর তাই 'হার্ড টাইমস' উপন্যাসের গ্র্যাডগ্রিন্ড চরিত্রটির মুখে বলতে শুনি-'জীবনে আমরা তথ্য ছাড়া আর কিছুই চাই না স্যার, তথ্য ছাড়া আর কিছুই না।' আর তাই মানুষ এখন হৃদয় যন্ত্রের খবর জানে, কিন্তু হৃদয়ের খবর জানে না। বাচ্চার পরীক্ষা হয়েছে? কেমন হলো তার ডিটেইলের দরকার নেই। সন্তান কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ে? বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা করে? ইন্টারনেটে চ্যাট করে? কার সঙ্গে মেলামেশা করে, কোন্ ধরনের বন্ধু-বান্ধব বা কার সঙ্গে কী ধরনের চ্যাট-এসব ডিটেইলের দরকার নেই। প্রতিবেশী বা অমুক আত্মীয় মারা গেছে। কখন কীভাবে কতদিন ভুগে মারা গেছে তার ডিটেইলের দরকার নেই। আবার মাঝে মাঝে মৃত্যুর খবরটাও দেরিতে পাই, ওই যে, আপডেট করিনি? কেমন আছেন, জিজ্ঞেস করলে ছোট্ট একটা শব্ধ কানে আসে 'ভালো'। ব্যাস্, ওই পর্যন্ত, কতখানি ভালো বা কোনো সমস্যা চলছে কিনা ইত্যাদি ডিটেইলের দরকার নেই। টিপাই ড্যাম টিপাই ড্যাম বলে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনছি কিন্তু জিনিসটা যে কী, কেন এত চিৎকার, তার ডিটেইলের দরকার নেই। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে? কেন বাড়ছে, কোন মেকানিজমের কারণে বাড়ছে, কতটা অর্থনৈতিক আর কতটা অনৈতিক, তার ডিটেইলের দরকার নেই। লক্ষ্য করুন, এখানে ডিটেইল শব্ধটা বার বার ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ এই ডিটেইলের মাঝেই লুকিয়ে আছে আমাদের ক্রমেই দূরে সরে যাওয়ার মূল সূত্রটি। সত্যজিৎ রায় তার সিনেমায় খুব যত্ম করে ডিটেইলের ব্যবহার করতেন বলেই তার ছবি এত বোধগম্য আর নান্দনিক হতো। আর আজ আমরা আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এই ডিটেইলের ব্যবহার ডিলিট করছি বলেই সবাই সবার কাছ থেকে ক্রমশ ডিলিট হয়ে যাচ্ছি। আর ডিলিট হয়ে যাচ্ছি বলেই দূরে সরে যাচ্ছি। দূরে সরে যাচ্ছি বলেই কেউ কাউকে বুঝতে পারি না, বুঝতে চাইও না। সে জন্যই কবীর সুমনকে গাইতে হয়, '... কথা বলে কথা না শুনে, কথার মানে যায় হারিয়ে'। কথার মানে হারিয়ে যায় বলে আজ আর সন্তানরা বাবা-মা'র কথা যেমন বুঝতে পারে না, বাব-মা'রাও তেমনি পারে না বুঝতে তাদের সন্তানদের। শিক্ষক পারে না ছাত্রদের বুঝতে, ছাত্ররাও তেমনি পারে না শিক্ষকদের বুঝতে। তবু ছাত্রদের তাদের অক্ষমতার কারণে ক্ষমাযোগ্য দৃষ্টিতে দেখা যেতে পারে। কিন্তু শিক্ষক? তার কি কোনো দায়িত্ব নেই? আর অফিস-আদালতের জন্য সেই কবে ব্রিটিশরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো দূরত্বের বেড়া তৈরি করে দিয়ে গেছেন অফিসের বড় কর্মকর্তা এবং অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে। যার জন্য সরকারি অফিসে চাকরির শুরুতে প্রশাসকদের শেখানো হয়...। এই দূরত্বের বেড়া বড় হতে হতে এখন দলীয় পর্যায়ে গিয়ে স্থান নিয়েছে। তুমি আমার দলের লোক নও? অতএব বদলী বা কম গুরূত্বপূর্ণ পদে পদায়ন। এই দেয়াল দেয়ার কারণে দেশের তিনটি বিভাগ-আইন, বিচার আর শাসন বিভাগ যেন তিনটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়েছে। তিনটি দ্বীপে যেন তিন ধরনের বাসিন্দার বসবাস। কেউ কাউকে চেনে না, চেনার চেষ্টাও করে না। এভাবে সমাজের প্রতিটা স্তরে দূরত্বের পাহাড় গড়ে তুললে বেচারা মোবাইল কোম্পানিগুলোর পক্ষে কী করে সম্ভব পরসপরকে কাছে রাখার? এই কাছে থাকার আরেকটা নমুনাস্বরূপ আজকাল ইংরেজিতে একটা গালভরা কথা প্রায়ই লিখতে দেখা যায়-কববঢ় রহ ঃড়ঁপয. ঞড়ঁপয অর্থাৎ সপর্শ। কিন্তু আমরা সপর্শ করতে গিয়ে এতই সপর্শকাতর হয়ে পড়ি যে, ছোট ছেলে বা মেয়েটা কোন্ অন্যায় করলো, কেন করল, কোন্ পরিস্থিতিতে করল-এসব না শুনেই ঠাস্ করে তার গালে একটা চড় দিয়ে বসলাম। কারও সঙ্গে কথা বলার সময় হয়তো মুখ ফসকে একটা অপ্রিয় সত্য কথা বের হয়ে এলো। আর যায় কোথায়, অমনি আমার বংশ তুলে গালাগাল শুরু করে দিল। আর পুরুষ হলে তো মারামারি লাগতেও বেশি সময় লাগে না। এই সপর্শকাতরতার জন্যই দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দলের মধ্যে এত কাদা ছোড়াছুড়ি হয় প্রায় প্রতিদিন। আর এভাবে যদি আমরা সবার সঙ্গে কববঢ় রহ ঃড়ঁপয খেলা খেলে যাই, আমাদের পক্ষে কি সম্ভব পরসপরের কাছে থাকার? আর এই ধরনের খেলা খেলতে পারেনি বলেই আলব্যের কামু... আর তাই তার জীবনটাকে সহজতর করার জন্য ম্যরসোর মধ্যে কোনো চেষ্টা দেখা যায় না। কারণ সে যা অনুভব করে তাই বলে। তার ভেতরে লুকোচুরির কোনো স্থান নেই। আর আমরা কত সহজে চুরি করে সমাজে সম্মানজনক স্থান নিয়ে বসে থাকি। কারও কিছু বলার নেই, কওয়ার নেই। আর এই একটি জায়গায় আমরা সবাই সবার কাছাকাছি থাকি। কারণ না থাকলে চুরির ভাগ পেতে অসুবিধা হবে যে! তবে এই সমাজে ম্যরসোর মতো যারা চুরি করতে পারে না, মিথ্যা বলতে পারে না, অভিনয় করতে জানে না-তারাই শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। কারণ তারা না পারে চুরি করতে, না পারে কিছু বলতে। তবে তারা ম্যরসোর চেয়েও দন্ডিত ব্যক্তি। কারণ তারা অন্যায় দেখেও নিশ্চুপ থাকে। আর সেজন্য ম্যরসোর চেয়েও তারা নিষ্ঠুর দন্ডে দন্ডিত হয়। এই জন্য যে, ম্যরসো মৃতুদন্ডে দন্ডিত হয়ে মরে গিয়ে নিষ্কৃতি পায় আর আমাদের ম্যরসোরা জীবিত থেকেও মৃতের মতো জীবনযাপন করে। আর এটা নিশ্চয়ই কোনো সুস্থ সমাজের লক্ষণ নয়? এতক্ষণে নিশ্চয়ই আমাদের কাছে থাকার কিছু নমুনা দিতে পারলাম এবং আরও বুঝলাম, এভাবে কাছে থাকার অভ্যস্ততায় অভ্যস্ত হতে থাকলে খুব বেশিদিন আর লাগবে না যে দিন আমরা নিজেরাই আর নিজেদের চিনতে পারব না। মানুষ বিছিন্ন হতে হতে শেষে এক-একজন একেকটা নির্জন দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে যাবে। যেখানে কারও মৃত্যুতেও আমরা আর শোক প্রকাশ করতে পারব না। কোনো শিশু ভূমিষ্ঠ হলেও আমরা আনন্দিত হতে পারব না। আমরা নিশ্চয়ই এরকম একটা সমাজ আশা করি না? না। কেউ না। কখনোই না। আর তাই আশা করি আমাদের যেন বেকেটের 'ওয়েটিং ফর গড'র এসত্রাগন চরিত্রটির মতো বলতে না হয়...

No comments

Powered by Blogger.