হরতাল ও প্রাসঙ্গিক বিষয় by হায়দার আকবর খান রনো

ত ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অর্ধবেলা হরতাল পালিত হয়েছে। তেল-গ্যাস বন্দর খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটি এই হরতালের ডাক দিয়েছিল। বঙ্গোপসাগরের তিনটি গ্যাসক্ষেত্র দুটি বিদেশি কোম্পানিকে (একটি মার্কিন ও একটি আইরিশ কোম্পানি) লিজ দিতে চলেছে বাংলাদেশ। লিজের শর্তানুসারে মজুত গ্যাসের ৮০ শতাংশ পাবে বিদেশি কোম্পানি, যা তারা গ্যাসকে তরলীকৃত করে রফতানি করতে পারবে।

বস্তুত বাকি ২০ শতাংশও বিদেশে রফতানি হওয়ার সম্ভাবনাই সর্বাধিক জাতীয় স্বার্থকে এভাবে জলাঞ্জলি দিয়ে বিদেশের কাছে গ্যাস তুলে দেয়ার ও গ্যাস রফতানির বিরুদ্ধে উপরোক্ত জাতীয় কমিটি প্রথম থেকেই প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে এবং প্রচার আন্দোলন করে আসছে। কিন্তু সরকার আন্দোলনের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করে বিদেশি কোম্পানির কাছে আমাদের গ্যাস সম্পদ তুলে দেয়ার চক্রান্তে তৎপর ছিল। এ ব্যাপারে সরকারকে একটু বেশি উৎসাহী মনে হয়েছে। এই অতি উৎসাহের কারণটি আমাদের অনুসন্ধান করতে হবে। বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় আসা ও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কি সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে? এটিই কি ছিল ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার প্যারোলে মুক্তি ও পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসার গোপন চুক্তি? এমন প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। টেলিভিশনের এক টকশোতে কমিউনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তেমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এরকম কথার ভিত্তিও আছে। শেখ হাসিনা তার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, ৫০ বছরের মজুত না রেখে গ্যাস রফতানি করা যাবে না। সেদিন তার এই বলিষ্ঠ দেশপ্রেমিক ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছিল। এর পরবর্তী নির্বাচনে ২০০১ সালে শেখ হাসিনার দল পরাজিত হয়। প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন খালেদা জিয়া। নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে, গ্যাস রফতানিতে সম্মত হননি বলেই তাকে হারানো হয়েছিল। অন্যদিকে শেখ হাসিনার অভিযোগ ছিল এই যে, খালেদা জিয়া গ্যাস রফতানিতে সম্মত হয়েছিলেন বলেই তাকে নির্বাচনে জিতানো হয়েছিল। শেখ হাসিনার কথা যদি তর্কের খাতিরেই সত্য বলে ধরে নেয়া হয়; তবে তারই কথার সূত্র ধরে আমরা কি এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, এবার তিনি আর আগের ভুল না করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শর্তে সম্মত হয়ে নির্বাচনে জেতার পথ পরিষ্কার করেছেন? কারণ শেখ হাসিনারই কথানুযায়ী মার্কিন প্রশাসন যেভাবে ঘুঁটি চালবে সেভাবে বাংলাদেশের নির্বাচনের ফলাফল তৈরি হবে এবং মার্কিন প্রশাসনকে তুষ্ট করতে হলে গ্যাস রফতানিতে সম্মত হতে হবে। শেখ হাসিনার অভিযোগ ২০০১ সালে খালেদা জিয়া তাতে রাজি হলেও তিনি রাজি হননি। সম্ভবত এবার শেখ হাসিনা সেই ভুল আর করেননি। নির্বাচনে জেতার পূর্বশর্ত হিসেবে তিনি কি আগেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে গোপনে কোনো শর্ত মেনে এসেছিলেন? আর সেটা পূরণ করার জন্য কোনোদিকে না তাকিয়ে মার্কিন কোম্পানির কাছে তুলে দিচ্ছেন বঙ্গোপসাগরের গ্যাসক্ষেত্র? হাবভাব ও সরকারের কার্যক্রম দেখে তো তাই মনে হয়। বলছিলাম যে, সরকার বিদেশি কোম্পানির কাছে গ্যাস তুলে দেয়ার ব্যাপারে যেন একটু বেশি উৎসাহী। এর প্রমাণ পাওয়া গেল ২ সেপ্টেম্বর যখন তেল-গ্যাস বন্দর খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটি পেট্রোবাংলা ঘেরাওয়ের কর্মসূচি পালনের লক্ষ্যে মুক্তাঙ্গন থেকে মিছিল সহকারে এগুচ্ছিল। পুলিশ প্রথমে সচিবালয়ের সামনে ও পরে বিজয়নগরে তারকাঁটার ব্যারিকেড দিয়ে লাঠিচার্জ শুরু করে। ১৪৪ ধারা ছিল না। মিছিল বেআইনিও নয়। এমনকি এই মিছিলের কর্মসূচিও পূর্ব ঘোষিত ছিল। পুলিশের এই আচরণ ছিল আকস্মিক ও চরমভাবে হঠকারী। শুধু তাই নয়, পুলিশ বেপরোয়াভাবে লাঠিচার্জ শুরু করে। জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মহম্মদসহ অর্ধশতাধিক গুরুতর আহত হয়েছেন। অধ্যাপক আনু মুহম্মদের দুই পায়ের হাড় ভেঙে দেয়া হয়েছে। তিনি এখনও চলাফেরা করতে পারেন না। এই ঘটনাটি কি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা বাড়াবাড়ি করেছে, নাকি সরকারেরই পরিকল্পনা ছিল তেল-গ্যাসের মতো ইস্যুতে আন্দোলন যাতে না বাড়তে পারে সেজন্য প্রথমেই দমন করা হোক। কারণ, এই ইস্যুটি সরকারের জন্য খুবই সপর্শকাতর; সত্যিই যদি বিদেশের কাছে গ্যাস তুলে দেয়ার ও রফতানি করার শর্ত দিয়ে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে থাকে। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম অবশ্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, বিগত জোট সরকারের আমলের পুলিশরা এখনও রয়ে গেছে, যারা এই জঘন্য কাজটি করেছিল। মন্ত্রীর কথা যদি সত্য হয়, তাহলে সেই দোষী পুলিশ অফিসারকে চিহ্নিত করা হোক, শাস্তি দেয়া হোক, যারা আনু মহম্মদকেই কেবল গুরুতরভাবে আহত করেনি, গণতন্ত্রকেও আঘাত করেছিল। কারণ মিছিল করার অধিকার আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ওই এক কথা বলেই নিশ্চুপ রয়েছেন। কারণ তিনি জানেন যে, জোট সরকারের ভূতের কথা বললেও আসলে সরকারের পূর্ব নির্দেশ অনুসারেই পুলিশ কাজ করেছে। ২ সেপ্টেম্বরের ঘটনার ব্যাপারে একটি তদন্তও এ পর্যন্ত হয়নি। বেশ কয়েকজন মন্ত্রী গেছেন হাসপাতালে অধ্যাপক আনু মহম্মদকে দেখতে। কিন্তু ওটা হলো উপরসা আচরণ মাত্র। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। জাতীয় কমিটি হরতালের ডাক দিলে মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে আবারও মুখ খুললেন। তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন। একটি হচ্ছে হরতাল প্রসঙ্গে, অপরটি হচ্ছে গ্যাস রফতানি প্রসঙ্গে। হরতাল প্রসঙ্গে তিনি জাতীয় কমিটিকে অভিযুক্ত করলেন। জাতীয় কমিটি নাকি জাতীয় সম্পদ রক্ষার নামে জাতির অর্থনৈতিক ক্ষতি করছে। কীভাবে? হরতাল হলে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। এর একটা হিসাবও দিয়েছে সরকারপন্হী দোকান মালিক সমিতি। অর্ধবেলা হরতালে ক্ষতি হবে নাকি পাঁচশত কোটি টাকা। বস্তুত বেলা বারোটা পর্যন্ত হরতাল মানে দুই ঘণ্টা বাজার বন্ধ থাকবে। তাতেই যদি ৫০০ কোটি টাকার লোকসান হয়, তাহলে দোকান মালিকরা সারাদিনে কী বিপুল অঙ্ক লাভ করেন, সেই হিসাবটা দোকান মালিক সমিতি জানিয়ে দিল। এই লাভের কত অংশ ট্যাক্স হিসেবে সরকারের পাওনা সেটাও মালিক সমিতির জানা থাকা উচিত। সেটা কি তারা দেন? বানোয়াট তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার কৌশল হিসেবে সরকার ও সরকারি দল এ ধরনের কিছু লোক ও মিডিয়াকে লেলিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কোনো কাজে আসেনি। হরতালে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় না এ কথা কেউ বলবে না। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থ আদায়ের জন্য এই ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে হরতাল একটি গণতান্ত্রিক হাতিয়ার, সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত, বিশ্বব্যাপী প্রচলিত এবং এই দেশেই ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা জনগণের প্রতিবাদের ও ন্যায়সম্মত প্রতিরোধের কৌশল। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম হরতালের ক্ষয়-ক্ষতির কথা তুলেছেন। তিনি সম্ভবত ভুলে গেছেন যে, মাত্র তিন বছর আগে তারই দল যখন বিরোধী অবস্থানে ছিল তখন কত হরতাল করেছিল। বলবেন, ওটা দেশের স্বার্থে করতে বাধ্য হয়েছিলাম। এখনও আমরা দেশের স্বার্থে, জাতীয় সম্পদ রক্ষার স্বার্থে, আমাদের গ্যাস বিদেশে পাচার প্রতিরোধের প্রয়োজনে বাধ্য হয়েছি হরতার ডাকতে। রোজার মাসে জনগণের কিছুটা কষ্ট হবে জেনেও আমরা বাধ্য হয়েছি। জনগণের স্বতঃসফূর্ত সমর্থন প্রমাণ করেছে যে, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে, আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাস দেশের মধ্যে রাখার প্রয়োজনে, সরকারের জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতাকে ঠেকানোর লক্ষ্যে জনগণ অর্ধবেলা হরতাল করতে এবং এতটুকু কষ্ট স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিল, এবং আছে। হরতালের বিরুদ্ধে কোনো কোনো মিডিয়ার ধারাবাহিক প্রচার আছে। কিন্তু তাদের পছন্দের দল যখন বিরোধী দলে থেকে হরতাল ডাকে, তখন তারা নিশ্চুপ থাকেন। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি বিরোধী দলে থেকে অনেক হরতাল করেছে। কিন্তু সরকারে গেলেই তাদের ভিন্ন রূপ। হরতালকে কোনোভাবেই সহ্য করতে পারে না। ১৯৯৬-২০০১ সালে শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন যে, ভবিষ্যতে কখনও বিরোধী দলে গেলেও তিনি হরতালের ডাক দেবেন না। কিন্তু তিনি তার কথা রাখতে পারেননি। অতএব, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বা অন্যরা হরতালের বিরুদ্ধে যে যুক্তি দিচ্ছেন তা কূট যুক্তি হিসেবেই বিবেচিত হবে। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের দ্বিতীয় কথাটি হলো-হরতাল কেন? আন্দোলন কেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই তো বলে দিয়েছিলেন '৫০ বছরের মজুত না রেখে গ্যাস রফতানি করা হবে না।' ধন্যবাদ সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে। তিনি নিজেই শেখ হাসিনার প্রায় বছর দশেক আগের কথাটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি পুনর্বার তার কথাটি উচ্চারণ করেন, এবং তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে আচরণ করেন তাহলে তো আন্দোলনের কোনো প্রয়োজনই হয় না। কিন্তু বাস্তবে দেখছি যে, শেখ হাসিনা তার আগের কথা থেকে অনেকদূর সরে এসেছেন। ২০০৮ সালের মডেল পিএসসি চুক্তির ভিত্তিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। তারই ভিত্তিতে দুটি বিদেশি কোম্পানিকে বঙ্গোসাগরের তিনটি গ্যাস ক্ষেত্র লিজ দেয়া হবে। এ ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে। গত ৭ আগষ্ট প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়া গেছে। ওই মডেল পিএসসিতে ৮০ শতাংশ গ্যাস বিদেশি কোম্পানি পাবে যা তারা বিদেশে রফতানি করতে পারবে। তাহলে কোনটা সত্য? ৮০ শতাংশ (বস্তুত পুরো একশ' ভাগই রফতানি করতে আমরা বাধ্য হব) রফতানির সুযোগ দিয়ে চুক্তি না কি শেখ হাসিনার আগের কথা '৫০ বছরের মজুত না রেখে গ্যাস রফতানি হবে না'। নাকি ইতোমধ্যেই এমন কিছু সন্ধান পাওয়া গেছে যাতে ৫০ বছরের মজুতের ব্যাপারে সরকার নিশ্চিত হয়েছে। এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বা সরকারের অন্য কোনো মুখপাত্র। তারা উত্তর দেয়ার প্রয়োজনও বোধ করেন না। এসব চুক্তির ব্যাপারে কোনো স্বচ্ছতা নেই, কোনো জবাবদিহিতা নেই। পার্লামেন্টেও আলোচনা হয়নি। জনগণকে আড়ালে রেখে বিদেশের কাছে দেশের স্বার্থ বিক্রির এক নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত তৈরি হতে যাচ্ছে। একে অবশ্যই রুখতে হবে। হরতাল মামুলি ব্যাপার। দল-মত-নির্বিশেষে সব দেশপ্রেমিক মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে হবে জাতীয় স্বার্থ বিক্রির এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। দেশকে যারা ভালোবাসেন তাদের সবারই এটা নৈতিক দায়িত্ব।

No comments

Powered by Blogger.