বাংলাদেশের অর্থনীতির কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব সাইফুর রহমান by আবুল কাসেম হায়দার

শান্ত, বিচক্ষণ, ধীশক্তিসম্পন্ন এম. সাইফুর রহমানের ৫০ বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতা বিশেষত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎপাদনমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান, রাসায়নিক, তেলগ্যাস উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ প্রতিষ্ঠান, পরিবহন, ব্যাংক-বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ও কনসালট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পূর্বঅভিজ্ঞতা থাকায় তার জন্য অর্থমন্ত্রীর কঠিন দায়িত্ব পালন অনেকটা সহজ হয়েছে।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়ার দু'দফার সরকারে ১২ বার রাষ্ট্রীয় বাজেট ঘোষণার বিরল গৌরবের অধিকারী এম সাইফুর রহমানের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা সমাজের সর্বস্তরে বিস্তৃত। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯ ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। এম. সাইফুর রহমান বাংলাদেশের অর্থনীতির কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব। তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর ব্যাপারে তার ভূমিকা ছিল অসামান্য। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন ও উন্নতি সাধিত হয়েছে তার অন্যতম রূপকার বা পুরোধা ছিলেন তিনি। দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি সংস্কার কর্মসূচির বাস্তবায়ন করেছেন সাইফুর রহমান। যে সব বিষয় বা উদ্যোগ দেশকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে তার সব উদ্যোগই সাইফুর রহমান নিয়েছেন। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করেছেন। কিছু বিষয় আমরা এখানে আলোচনা করব : ১) বাণিজ্য উদারীকরণ : বাংলাদেশের অর্থনীতি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার পরিচালিত সীমিত অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৭২ সালে সব বিদেশি শিল্পকারখানাকে জাতীয়করণ করা হয়। সরকার দেশে সকল প্রকার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করে। স্বাধীনতার পর দেশের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ২ শতাংশ। ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশের বাজেট ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার, যা ২০০৬ সালে দাঁড়ায় ৬৯ হাজার কোটি টাকায়। ১৯৭৫ সালে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাইফুর রহমান প্রথম জিয়াউর রহমানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৮০ সালে তিনি প্রথম জিয়াউর রহমানের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করেন। বাণিজ্যকে উদার ও বহুমুখীকরণের কাজ শুরু করেন সাইফুর রহমান। তার এই উদার রাজনৈতিক কর্মকান্ড দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ২) বেসরকারিকরণ উদ্যোগ : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের অর্থনীতি ছিল খুবই ভঙ্গুর, দুর্বল। আবার ১৯৭২ সালে সকল শিল্পকারখানা জাতীয়করণ করা হলো। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মালিক হলেন দেশের কলকারখানার। পরিণতিতে শিল্পকারখানাগুলো হয়ে উঠল অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ক্ষতির বোঝা সরকারকে টানতে হলো। ১৯৮০-৮১ সালে প্রথম বাজেট ঘোষণা করেন এম. সাইফুর রহমান। তার আমল থেকে প্রকৃতপক্ষে বেসরকারিকরণের দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। যদিও বেসরকারিকরণের প্রকৃত উদ্যোগ নেয়া হয় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমল থেকে। তিনিই প্রথম বেসরকারি সংস্থা তথা প্রাইভেটাইজেশন কমিশন গঠন করেন। ৩) ভ্যাট প্রচলন : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভ্যাট একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ভ্যাট প্রথা সাইফুর রহমান বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে দেশে চালু করেন। দেশের রাজস্ব আদায়ে ভ্যাট বিশেষ ভূমিকা রাখছে। ২০০৬ সালের বাজেটে দেখা গেছে দেশের বাজেটের ৪৩ শতাংশ অর্থ জোগানো ভ্যাট চালু হওয়ার ফলে সম্ভব হয়েছে। সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে ভ্যাট প্রথা বেশ সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। ৪) বসত্রশিল্পে তথা তৈরি পোশাক শিল্পে অবদান : আজ দেশের তৈরি পোশাক শিল্প ৭৬ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। প্রায় ২০ লাখ শ্রমিক তৈরি পোশাক শিল্পখাতে কর্মে নিয়োজিত। বসত্রখাতে শ্রমিক নিয়োজিত প্রায় ২৫ লাখ। উইভিং, ডাইং, সিপনিং খাতসহ বসত্রখাতের এই বিশাল উত্থান সাইফুর রহমানের একক প্রচেষ্টায় বলা যায়। ব্যাক টু ব্যাক এলসি, বন্ডেড ওয়্যার হাউস প্রথা চালু অবস্থায় রেখে সাইফুর রহমান বসত্রখাতের ভিত্তিকে শক্তিশালী করেন। সাইফুর রহমান বসত্রখাতের উন্নয়নের জন্য ক্যাশ ইনসেন্টিভ চালু করেন। ২৫ শতাংশ হারে তৈরি পোশাক খাতে ক্যাশ সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে বসত্রখাতের শিল্পে আমূল পরিবর্তন আনেন। ৫) আইটি সেক্টরের উত্থান : সাইফুর রহমানের হাতের ওপর দিয়ে বাংলাদেশের আইটি সেক্টর ধীরে ধীরে এগিয়ে এসেছে। কম্পিউটার ও তার সকল প্রকার যন্ত্রাংশের ওপর ১০০ ভাগ কর মওকুফ করে দেশে কম্পিউটার বিপ্লব শুরু করেন। ৬) মোবাইল ফোন বিপ্লব : বাংলাদেশে মোবাইল ফোন সাইফুর রহমান আমলে ব্যবসা শুরু করে। প্রথমে এ দেশে সিটিসেল মোবাইল আসে। সাইফুর রহমানের হাত ধরে বর্তমানে ৬টি মোবাইল কোম্পানি দেশে ব্যবসা করছে। ৭) শেয়ার মার্কেট : বাংলাদেশে ক্যাপিটাল মার্কেট বিস্তার শুরু হয় ১৯৭৫ সালের পর। ঢাকা ষ্টক এক্সচেঞ্জ শহীদ জিয়াউর রহমানের সময় আবার সক্রিয় করে তোলা হয়। ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৮ সালে শেয়ার মার্কেটে ধস নামে। পরবর্তী সময়ে ২০০১ নির্বাচনের পর অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান তার কড়া নজরে শেয়ার মার্কেটের ভিত্তি শক্ত করেন। সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনকে শক্তিশালী করেন। দক্ষ জনশক্তি ও নীতিমালার মাধ্যমে এসইসিকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় নিয়ে আসেন। ৮) ব্যাংক ও অ-আর্থিক খাতের উন্নয়ন : বাংলাদেশের ব্যাংকিং জগতের জন্য এক অসাধারণ নীতিমালা প্রণয়ন করে এই খাতকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন। ব্যাংক ও আর্থিক খাত আজ বাংলাদেশে বেশ শক্তিশালী। ১৯৯৬-২০০১ সালে তখনকার সরকার ১২টি ব্যাংক ও বহু বীমা প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়ে এই খাতকে বেশ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। সাইফুর রহমান শক্ত হাতে এই খাতকে দাঁড় করানোর ফলে বিশ্বমন্দায়ও বাংলাদেশের আর্থিক খাতের কোনো ক্ষতি হয়নি। লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইষ্টার্ন ইউনিভার্সিটি, সাবেক সহসভাপতি, এফবিসিসিআই

No comments

Powered by Blogger.