রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেলেন নাঃ অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান

ড়ক দুর্ঘটনায় নিহত দেশের সফলতম অর্থমন্ত্রী ও বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য এম সাইফুর রহমানকে নিজ জন্মভূমি মৌলভীবাজারের বাহারমর্দানে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে গত ৭ সেপ্টেম্বর বিকালে। দলমত নির্বিশেষ লাখো মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত সাইফুর রহমানের সব ক'টি জানাজায় মানুষের ঢল নেমেছিল

এই বর্ষীয়ান রাজনীতিকের রুহের মাগফিরাত কামনা ও মরদেহ দেখতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াসহ বিশিষ্ট রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীরা ছুটে এসেছিলেন। দীর্ঘ ৭৭ বছরের জীবনে সাইফুর রহমান শুধু নিজ পেশাতেই সফল ছিলেন না, রাজনীতিক হিসেবেও তার সাফল্য ঈর্ষণীয়। যৌবনের শুরুতে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তিনি কারাবরণ করেছিলেন। পৌঢ়ত্বে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে রাজনীতিতে এসেও তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১২টি জাতীয় বাজেট তৈরিতে তার দক্ষতা ছিল চোখে পড়ার মতো। তার হাতেই বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতির ভিত্তি রচিত হয়েছে। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির পরিবর্তে মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারা চালু করতেও তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে সাইফুর রহমানের নামও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উচ্চারিত হয় সম্মানের সঙ্গে। বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর আলোচনা-সমালোচনায় সাইফুর রহমানের নাম বাদ দেয়া সম্ভব হবে না কারও পক্ষেই, এটা জোর দিয়ে বলা যায়। বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে রক্ষিত শোক বইতে স্বাক্ষর করে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূস সঠিকভাবেই তাকে বাংলাদেশের নতুন অর্থনীতির বুনিয়াদ রচয়িতা হিসেবে সম্মান দেখিয়েছেন। এরকম একজন সফল অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিক ও জাতীয় ব্যক্তিত্বের অকস্মাৎ মৃত্যুতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল গভীর শোক ও সহানুভূতি প্রকাশ করেছে স্বাভাবিকভাবে। অন্যদের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীও সাইফুর রহমানের মৃত্যুতে শোকবার্তা পাঠিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও সরকার এক্ষেত্রে নির্বিকার ভূমিকা পালন করেছে। এটা আমাদের জন্য দুঃখ ও লজ্জার ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিদেশ থেকে ফিরে এলেও সাইফুর রহমানের মরদেহ দেখতে বা তার পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। তিনি বা তার সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো শোকবার্তাও দেয়নি। জীবিত সাইফুর রহমান তার ভূমিকার জন্য ভাষাসৈনিক হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে একুশে পদকসহ নানাভাবে সম্মানিত হলেও মৃত্যুর পর তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বিএনপি মহাসচিবের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের আহ্বান জানানো হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এটি আওয়ামী মহাজোট সরকারের সঙ্কীর্ণ ও অসুস্থ মানসিকতা তুলে ধরে। সাইফুর রহমানের মতো জাতীয় ব্যক্তিত্বকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান না জানিয়ে সরকারি নীতিনির্ধারকরা নিজেদের সম্মানহানি ঘটিয়েছেন- অস্বীকার করা যাবে না। জনগণ ঠিকই তাকে সম্মান জানাতে ভেঙে পড়েছে। সরকারের ভূমিকায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্ট জনরা। এটা যে বাংলাদেশের সংঘাতমূলক ও পঙ্কিল রাজনীতির প্রতিফলন-সেটাও তারা উল্লেখ করেছেন। এ ধরনের মানসিকতা ভবিষ্যতে জাতির জন্য কঠিন দুঃখ-কষ্ট ডেকে আনবে বলেও তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মনীষী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর উক্তি তুলে ধরে তারা বলেছেন, 'যে জাতি গুণীজনকে কদর করতে জানে না, সেদেশে ভালো মানুষ জন্মায় না।' ঢাকঢোল পিটিয়ে দিনবদলের ঘোষণা দিলেও সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকরা নিজেদের সঙ্কীর্ণ মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠতে যে সক্ষম হননি, সেটি আবারও প্রমাণ হলো এ ঘটনা থেকে। সাইফুর রহমান সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও মর্যাদা লাভ করলেও সরকার এক্ষেত্রে এক পাও এগিয়ে আসেনি। অতীতে ওয়াহিদুল হক, বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য, আবদুল কুদ্দুস মাখনসহ অনেকেই জীবনের শেষযাত্রায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করলেও সাইফুর রহমান কেন এ থেকে বঞ্চিত হলেন-সে প্রশ্ন মানুষকে তাড়িত করবেই। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন দূরে থাক, রাষ্ট্রীয়ভাবে তার লাশ পরিবহনের কোনো সুব্যবস্থাও করা হয়নি। ঢাকা-সিলেট-মৌলভীবাজার পর্যন্ত দীর্ঘ সড়কপথের পরিবর্তে হেলিকপ্টারে সাইফুর রহমানের লাশ নেয়ার ব্যবস্থা করা মোটেই অসম্ভব ছিল না সরকারের পক্ষে। এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করা মোটেই অসঙ্গত হবে না যে, বিগত বিএনপি জোট সরকারের আমলে সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সামাদ আজাদের মরদেহ দেখতে গিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে লাশ পরিবহনের ব্যবস্থা করেছিলেন। এ ঘটনার কথা নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ নেতারা ভুলে যাননি। তারপরও সাইফুর রহমান শেষ বিদায়ের সময় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভে বঞ্চিত হলেন, এ দুঃখ মানুষ ভুলতে পারবে না।

No comments

Powered by Blogger.