সিটি পৌর ও ইউপি নির্বাচন চার মাস পর : বিএনপির প্রস্তুতি কতদূর

বিরোধী দল শক্তিশালী ও তৎপর না হলে গণতন্ত্র একপেশে হয়ে পড়ে। তখন সরকার স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার সুযোগ পায়। স্বৈরাচারী শাসকের উত্থান ঘটার এটাও একটা পথ। সে ধরনের সরকার গায়ের জোরে এবং নানা কূটকৌশলে বিরোধী দলকে কোণঠাসা করতে এমন কোনো পথ নেই যা গ্রহণ করে না। এমন অবস্থা মোকাবিলায় বিরোধী দলের পক্ষে নিজেদের সংগঠন ও গণভিত্তি শক্তিশালী করে, সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামার বিকল্প নেই।

সরকারের ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টিতে আন্দোলন-সংগ্রাম ও নির্বাচনই গণতন্ত্র সম্মত পন্হা। এ পথেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের দুর্বলতার পেছনে আর্থ-সামাজিক কারণ ছাড়াও সরকারি দলের অগণতান্ত্রিক ভূমিকার পাশাপাশি বিরোধী দলের দায়িত্ব পালনে অপারগতাও যে সমান দায়ী সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমানে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির ভূমিকা বিষয়টিকে আবারও সামনে হাজির করেছে। নয় মাস বয়সী আওয়ামী মহাজোট সরকারের সাফল্যের দাবিদার এখন পর্যন্ত শুধু তারা নিজেই। দলের নেতানেত্রী ও মন্ত্রীদের মুখের কথার সঙ্গে বাস্তবের বৈপরীত্যের এই মুহূর্তের বড় প্রমাণ বাজার পরিস্থিতি। বাজার নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর কথার তালে অস্থির হয়েছে দ্রব্যমূল্য। রমজানে, ঈদের আগে এখন চিনির দাম আকাশ ছোঁয়া হয়ে উঠেছে। মুখ রক্ষার জন্য আবিষ্কার করা হয়েছে- এ জন্য দায়ী বিগত সরকার। বিএনপি জোট সরকারকেও টেনে আনা হয়েছে চিনি সঙ্কটের দায় চাপাতে। এর আগে এ কথা কারও মুখে শোনা যায়নি কেন, সে প্রশ্ন তুলে ধরার মতো কার্যকর অবস্থায় কি আছে বিএনপি? দলটি বীর উত্তম জিয়াউর রহমান সড়কের নামফলক ভাঙা নিয়েও আশানুরূপ কিছু করেনি। যদিও দলটির প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং জিয়াউর রহমান। এ অবস্থা এমনি এমনি সৃষ্টি হয়নি। বিদেশি মদতপুষ্ট সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল যে বিএনপি, সেটি এখন সবার কাছেই পরিষ্কার। বিএনপিকে ধ্বংস করা আড়াল করতেই তখন আওয়ামী লীগের গায়েও হাত তোলা হয়েছিল। সে বিপর্যয় কাটিয়ে দ্রুত নিজেদের গুছিয়ে নিতে বিএনপি এখনও আশাব্যঞ্জক কিছু করে উঠতে পারেনি। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত, ব্যক্তিকেন্দ্রিক গ্রুপে বিভক্ত, অন্তহীন দ্বন্দ্ব কলহে লিপ্ত নেতাকর্মীরা কীভাবে বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে- সেটা কারও পক্ষেই বুঝে ওঠা দুঃসাধ্য। এ অবস্থায় জাতীয় নির্বাচনের বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার আগেই হাজির হচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। আর মাত্র চার মাস পরই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সারাদেশে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। সেই সঙ্গে হবে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনও। এসব নির্বাচনকে অরাজনৈতিক বলা হলেও বাস্তবে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাই প্রাধান্য লাভ করতে দেখা যায়। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা ও প্রভাব বিস্তার করার ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রতিনিধিত্ব যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সাংগঠনিক ভিত্তি শক্তিশালী করার জন্যও অপরিহার্য। অথচ এখন পর্যন্ত দেশের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি এ ব্যাপারে একেবারে অপ্রস্তুত। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সর্বত্র দাপটের সঙ্গে বিচরণ করছে। জাতীয় নির্বাচনের হাওয়া তারা এই স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও জোরেশোরে বইয়ে দিতে চায়। তৃণমূল পর্যায়ে তারা নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও সাংগঠনিক শক্তিতে অনেক এগিয়ে। এ অবস্থা সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা সাধারণ মানুষের মনে যে ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি করেছে, সেটা তাদের আমলে না আনার জন্য যথেষ্ট। এখানেই প্রয়োজন বিরোধী দলের কার্যকর ভূমিকা। এমনি পরিস্থিতিতে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা এবং জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ও ইসলামী মূল্যবোধের প্রভাবই যথেষ্ট নয়, আওয়ামী মহাজোট সরকারের নয় মাসের দুঃশাসন ও ব্যর্থতাকে তুলে ধরে আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন আরও সুশৃঙ্খল সাংগঠনিক তৎপরতা ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ। বিষয়টির গুরুত্ব দলটির নীতিনির্ধারক ও সর্বোচ্চ নেতৃত্ব নিজেদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন বলে আমাদের ধারণা। অতএব, কালবিলম্ব না করে যাবতীয় ক্ষুদ্রস্বার্থ ও সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ ও সর্বস্তরে বিশৃঙ্খলা দূর করে সংগঠিত হতে না পারলে এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণে সক্ষম না হলে শুধু দল হিসেবে বিএনপি নয়, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎও হুমকির মুখে পড়বে।

No comments

Powered by Blogger.