বেতন-বোনাসের দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষ

রোজা শেষে ঈদের আর মাত্র দিন দুয়েক বাকি। ঈদের বাজারে বেচাকেনা শেষ পর্যায়ে। মানুষ দলে দলে ছুটছে প্রিয়জনের কাছে, নাড়ির টানে। কিন্তু যারা এখনও মাসিক বেতন ও ঈদ বোনাস পায়নি, তাদের কী হবে। কখন তারা কেনাকাটা করবে, বাড়ি যাবে? বিশেষ করে গার্মেন্ট শ্রমিক, যারা প্রায় কখনোই নিয়মমত বেতন-ভাতাদি পায় না, এই ঈদের সময়ও কি তারা বঞ্চিতই থাকবে! তারা দিনরাত পরিশ্রম করে অথচ সময়মত বেতন পায় না।
তাদের খাওয়া-পরা, বাড়ি ভাড়া ইত্যাদি নিয়ে কী অবস্থা হয়, সেটা কেউ চিন্তা করে বলে মনে হয় না। গার্মেন্ট কারখানায় নির্বাচিত শ্রমিক ইউনিয়নও নেই যে তাদের মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান হবে। তাই বাধ্য হয়েই তাদেরকে বেতনের দাবি তুলতে হয়। রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ-অবরোধ করতে হয়। পুলিশ-গুন্ডা-মাস্তানদের পিটুনি খেতে হয়। 'ষড়যন্ত্রকারী', 'চক্রান্তকারী' হতে হয়। কেউ বুঝতে চায় না তাদের পেটের জ্বালা! ২৭ রোজাতেও বেতন-বোনাসের দাবিতে গার্মেন্ট শ্রমিকদের রাস্তায় নেমে আসতে হয়েছে। ঢাকার মহাখালী, মিরপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভারসহ বিভিন্ন এলাকার গার্মেন্ট শ্রমিকরা এক প্রকার মরিয়া হয়েই বিক্ষোভ করেছে। তারা কারখানা ঘেরাও করেছে, সড়ক অবরোধ করেছে। মালিকের বাড়িতে চড়াও হয়েছে। এখন অনেক মালিক কারখানায় আসাই ছেড়ে দিয়েছেন। মহাখালীর টেক্সটো গার্মেন্টের ভারতীয় মালিক তরুণ শেঠি শ্রমিকদের বেতন-বোনাস না দিয়েই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। এ খবর শুনে শত শত শ্রমিক কারখানা অবরোধ করলে গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ নেতারা এসে শ্রমিকদের আংশিক বেতনের ব্যবস্থা করে তাদের শান্ত করেন। ঢাকার পাশেই রূপগঞ্জের ভুলতায় হার্ভেষ্ট রিচ গার্মেন্টের শ্রমিকরাও রাস্তায় নেমে এসেছিল। তাদের দু'মাসের বকেয়া বেতন, ওভারটাইম ও ঈদ বোনাস কথামত না দেয়ায় তারা রাস্তায় বিক্ষোভ করতে থাকলে মালিক পক্ষ মাইকে বেতন-ভাতা-বোনাস পরিশোধের আশ্বাস দিলে শ্রমিকরা দিনের শেষে ঘরে ফিরে যায়। একইভাবে সাভার থানা বাসষ্ট্যান্ডের পাশে হান অ্যাপারেল গার্মেন্টে বেশ কিছুদিন থেকে বেতন-বোনাস দেয়ার আশ্বাস দিয়েও তা পরিশোধ না করায় গত বৃহসপতিবার তারা সড়ক অবরোধ করে। তখন স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন মালিক পক্ষকে ডেকে এনে সমস্যার সমাধান করে। এসব ঘটনা থেকে এটা পরিষ্কার, প্রচলিত আইন অনুযায়ী গার্মেন্ট মালিকরা চলেন না। সরকার বা বিজিএমইএ'র সিদ্ধান্তও তারা থোড়াই কেয়ার করেন। মন্ত্রীরা বা মালিক পক্ষ মুখে যাই বলুক না কেন, কিছু গার্মেন্ট মালিকের কারণেই শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। মালিকরা যেমন নিজেদের ঈদ আয়োজনে সচেষ্ট, তেমনিভাবে যদি শ্রমিকদের বিষয়ে আন্তরিক হতেন তবে তারা সময়মতই সবার বেতন-বোনাস পরিশোধের ব্যবস্থা নিতেন। তাহলে আর বিজিএমইএ'র ২০টি টিমকে মাঠে নামতে হতো না। এটাই আমাদের কথার সত্যতা প্রমাণ করে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে বাণিজ্যমন্ত্রী ঈদের আগেই গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। গার্মেন্ট মালিকদের সঙ্গে বৈঠকের সূত্র ধরে তিনি বলেছেন, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নেতারা সরকারকে এ বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু কিছু মালিক যে কোনো কিছুকেই পরোয়া করে না, সেটা বাস্তব পরিস্থিতিই প্রমাণ করে। বিজিএমইএ সভাপতি ঈদের আগেই সব গার্মেন্ট কারখানায় বেতন-বোনাস হবে বললেও গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে কমপক্ষে ৫০টি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে বেতন-বোনাস না দেয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে বলে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। একই আশঙ্কার কারণেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শ্রমিকদের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ-ঘেরাও-অবরোধ করতে হচ্ছে। আমরা আশা করব, কালবিলম্ব না করে সব কারখানার শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধের বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। কোনো শ্রমিক যেন ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয়, মালিক পক্ষ ও সরকারকেই তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। শ্রমিক আন্দোলন দমনে তারা যেভাবে সচেষ্ট, সেভাবে যদি অবাধ্য মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতো তবে কোথাও অশান্ত অবস্থা সৃষ্টি হতো না-এটা জোর দিয়ে বলা যায়। শুধু মুখের কথায় যে কাজ হয় না সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই মুখ খোলার আগে 'কথায় চিড়ে ভিজে না' কথাটা সবারই মনে রাখা দরকার। বিশেষ করে যারা মানুষকে আশ্বস্ত করেন তারা যদি এটা ভুলে যান তবে চড়া মাশুল গুনতে হবে তাদের।

No comments

Powered by Blogger.