মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হামলা by এবনে গোলাম সামাদ

০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলা ছিল একাধিক দিক থেকেই বিস্ময়কর। এর আগে কেউ ভাবতে পারেনি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিমান ছিনতাই করে এরকম হামলা কোনো গোষ্ঠীর পক্ষে ঘটানো আদৌ সম্ভব হতে পারে। কিন্তু অসম্ভব হতে পেরেছিল সম্ভব। জীবনবাজি রেখে কিছু আরবিভাষী তরুণ ঘটিয়েছিল এই কান্ড। আত্মঘাতী হয়েছিলেন তারা। এরা সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং বিত্তবান ঘরের সন্তান।

এরা যা কিছু করেছিলেন, তা করেছিলেন একটা আদর্শেরই টানে। তা সে আদর্শকে নিয়ে যদিও থাকতে পারে যথেষ্ট বিতর্ক। কিন্তু তারা যে ব্যক্তিগত স্বার্থে অনুপ্রাণিত হয়ে এরকম হামলা চালাননি সেটা আজ মনে হয় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। তবে অনেক ঘটনাই থেকে গেছে রহস্যঘেরা। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে এরা কী প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন তা আমরা জানি না। তবে সম্ভবত তারা জানতেন, এটা পেতে পারবে একটা বিরাট প্রচার মূল্য। বিশ্ব ভাবতে পারবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হামলা করা মোটেও অকল্পনীয় নয়। নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে হামলা হওয়ার ফলে মারা যায় প্রায় ৩ হাজার মানুষ। সংখ্যার দিক থেকে এটাকে খুব কম বলা যায় না। একই দিনে পেন্টাগনেও হামলা হয়েছিল। আর সেখানেও মারা যায় কম করে ৩০০ ব্যক্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর পরিকল্পনার এই কেন্দ্রে আঘাত করে সম্ভবত আক্রমণকারীরা একথাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, মার্কিন সমর পরিকল্পনা কেন্দ্রকে অকেজো করা অসম্ভব নয়। হোয়াইট হাউসের ওপরও একই দিনে একইভাবে হামলা হতে যাচ্ছিল। কিন্তু এই হামলা সফল হতে পারেনি। সফল হলে ডিক চেনির মৃত্যু হতে পারত। ২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সহজে মুছে যাওয়ার নয়; যদি আগামীতে আরও কোনো ভয়াবহ হামলার ঘটনা না ঘটে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার খবর অনুসারে যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছিল তারা সবাই ছিল আল কায়দার সদস্য। কিন্তু এই অভিযোগ কতটা সত্য সে বিষয়ে সন্দেহ থেকে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আল কায়দা দমনের জন্য আফগানিস্তান দখল করে। কিন্তু আল কায়দা নেতাদের কাউকেই তারা ধরতে সক্ষম হয়নি। আল কায়দাদের সেভাবে ধরার চেষ্টা না করেই যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০০৩ সালের ২০ মার্চ শুরু হয় বর্তমান ইরাক যুদ্ধ। অথচ আমরা এখন পরিষ্কার জানি, সাদ্দাম হোসেন ও তার বাথ পার্টির সঙ্গে আল কায়দার সুদূর যোগাযোগ ছিল না। আর যারা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হামলায় অংশগ্রহণ করেছিল তাদের মধ্যে কেউ ছিল না ইরাকের নাগরিক। ইরাকে আজও যুদ্ধ চলছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা নতুন উদ্যমে যুদ্ধ শুরু করেছেন আফগানিস্তানে, যা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে পাকিস্তানেও। কেন বুশ প্রশাসন আফগানিস্তানে যুদ্ধ প্রায় স্থগিত করেছিল, ইরাকে আক্রমণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল-এখনও তা আছে বিশেষভাবেই অজ্ঞাত। বুশ প্রশাসনের প্রথম দিকের পরাষ্ট্র সচিব কলিন পাওয়েল বলেন, সম্পূর্ণ ভুল তথ্যের ওপর নির্ভর করে শুরু হয় ইরাক যুুদ্ধ। আর তিনি এটা উপলব্ধি করতে পেরেই তার পররাষ্ট্র সচিব পদে ইস্তফা দেন। ইরাক যুদ্ধ আজও চলছে। এই যুদ্ধের শেষ কোথায়, কখন হবে, তা অনুমান করা যাচ্ছে না। এখন অবশ্য ইরাক যুদ্ধে আল কায়দারা অনেক ক্ষেত্রেই গ্রহণ করছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ইরাকের বহু মানুষকে করে তুলেছে আল কায়দার প্রতি সহানুভূতিশীল। ইরাক যুদ্ধ বাড়িয়েছে আল কায়দার প্রভাব-প্রতিপত্তি। আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে আল কায়দা ভীতির কথা। বলেছে, আল কায়দাকে ধ্বংস করতে না পারলে মার্কিন নাগরিকদের জীবন নিরাপত্তা পেতে পারবে না। কিন্তু আবার আসছে ইরানের কথা। ইরান পরমাণু বোমা তৈরি করছে। এটা নাকি হতে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ হুমকি। প্রথমত এখনও প্রমাণিত হয়নি যে ইরান পরমাণু বোমা বানাতেই যাচ্ছে। আর দ্বিতীয়ত প্রমাণিত হয়নি যে ইরানের হাতে এমন রকেট আছে যা ইরান থেকে পরমাণু বোমা বহন করে আঘাত করতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মনে হচ্ছে ইরাকের মতোই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে কব্জা করার একটা অজুহাত সৃষ্টি করতে চাচ্ছে মাত্র। কিন্তু ইরানকে আক্রমণ করলে যুদ্ধ নেবে ভয়াবহ রূপ। আর যার জয়-পরাজয় হবে অনেক অনিশ্চিত। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বন্ধু দেশ হলো সৌদি আরব ও মিসর। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে এরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো বড় রকমের সমর্থন দিতে পারবে বলে মনে করার কারণ নেই। ফিলিস্তিনে হামাসরা ইরানমুখী হয়ে উঠেছে। লেবাননে হিজবুল্লাহ হয়ে উঠেছে প্রচন্ড শক্তিশালী। ইসরাইলকে জড়াতে হবে বড় রকমের যুদ্ধে। রুশ প্রধানমন্ত্রী পুতিন হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, এরকম যুদ্ধের পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। রাশিয়া আগের মতো এখন আর দুর্বল নয়। সমর শক্তিতে সে অর্জন করেছে বিরাট সাফল্য। সে যদি ইরানের পক্ষ নেয়, তবে ইরানের সমর সম্ভারের অভাব হবে না। সমস্ত ল্যাটিন আমেরিকায় মার্কিনবিরোধী মনোভাব প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। পশ্চিম গোলার্ধে ফুরিয়ে আসছে সাবেক মার্কিন আধিপত্যের দিন। বিখ্যাত মনরো ডকট্রিন হয়ে উঠেছে অকেজো। রাশিয়ান অসত্র জাহাজে করে যাচ্ছে ভেনিজুয়েলায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতে সক্ষম হচ্ছে না বাধা দিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাই আগের মতো আর সমুদ্র ঘেরা নিরাপদ রাষ্ট্র নয়। স্থলপথেও তার ওপর হতে পারে একটা হামলা। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে বিগত আট বছরে বিশ্ব পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাম্প্রতিক নির্বাচনে জাপানে যে দল ক্ষমতায় এলো, তারা পরিত্যাগ করতে যাচ্ছে মার্কিনঘেঁষা নীতি। এটাও দুর্বল করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুদ্ধ করেই চলেছে। যুদ্ধ করেছে সে কোরিয়ায়; কিন্তু জিততে পারেনি। এরপর সে যুুদ্ধ করেছে ভিয়েতনামে, কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধে সে হয়েছে নিশ্চিতভাবেই পরাজিত। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিণতি হতে পারে ভিয়েতনামের চেয়েও বহুগুণে ভয়ঙ্কর। বাংলাদেশকে তার পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে বিবেচনায় নিতে হবে পরিবর্তিত এই বিশ্ব পরিস্থিতিকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ভূমিকায় আর উপবিষ্ট নয়। বিশ্বজুড়েই এখন চলছে বাণিজ্যমন্দা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান লাভের আশায় আমরা হতে পারি না মার্কিন ভক্ত। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের সময় এ বিষয়টিও থাকা উচিত বিশেষ বিবেচনায়। ২০০১ সালের পর আজ কেটে গেছে ৮ বছর। আট বছর একটা লম্বা সময় নয়। কিন্তু এর মধ্যে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা, যেগুলো আমাদের বিশেষ বিবেচনা পাওয়ার দাবিদার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের কথা বলে। কিন্তু বিগত নির্বাচনে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সে পালন করেছে কার্যত গণতন্ত্রবিরোধী ভূমিকা। গণতন্ত্রের অজুহাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের অধিকার আর পেতে পারে না। গণতন্ত্র কাম্য, কিন্তু মার্কিন অধিকারতন্ত্র হতে পারে না আমাদের মতো কোনো দেশের জন্য বাঞ্ছিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কেবল গণতন্ত্রের কথা বললেই হবে না, তাকে অন্য দেশের ক্ষেত্রেও হতে হবে গণতন্ত্রী। আর গণতন্ত্রের নামে ছাড়তে হবে অন্য দেশে হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টা। ওবামাকে বলতে শোনা গেল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আবার আল কায়দার হামলা হতে পারে। ওবামা বহু প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু আমেরিকার আর্থিক মন্দা তাকে ন্যুব্জ করে ফেলেছে। তিনি হয়তো চাচ্ছেন বিগত বুশ প্রশসানের মতোই আল কায়দার ভয় ছড়িয়ে তার নিজের ক্ষয়িষ্ণু জনপ্রিয়তাকে কিছুটা ধরে রাখতে। পাকিস্তান বলছে, ওসামা বিন লাদেন আর বেঁচে নেই। আল কায়দারা এখন হেরে যাওয়ারই পথে। কিন্তু তবু ওবামা বলছেন, আল কায়দা নতুনভাবে সংগঠিত হয়ে হামলা চালাতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর-যা প্রতিহত করার জন্য মার্কিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে থাকতে হবে সদা সতর্ক।

No comments

Powered by Blogger.