একটুখানি আশার আলো by সাইফুদ্দীন চৌধুরী



আমার এক অধ্যাপক বলছিলেন, খবরের কাগজে লেখালেখি করে কোনো কাজ হয় কি? অযথা তোমরা সময় নষ্ট করো। বন্ধুকে বলেছিলেম, কথাটা নির্জলা মিথ্যা নয়। তবে, কাজ একটু-আধটু যে হয় না, তা নয়। প্রচারমাধ্যমে বিশিষ্টজনেরা যে অভিমত রাখেন কিংবা পরামর্শ দেন, কর্তৃপক্ষ তা নজরে এনে সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা তো করেই। তাঁকে গত বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা চলার সময়ের একটি ঘটনার উল্লেখ করে বললাম, ওই সময় তো শহর-গ্রাম ছেয়ে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের ঢাউস আকারের পতাকায়। দেশের মাটিতে বিদেশি পতাকা নিয়ে হই-হুল্লোড় দেখে অনেকের কাছে বিষয়টি বিসদৃশ মনে হওয়ায় কেউ কেউ খবরের কাগজে বিরূপ মন্তব্য করেন। সরকার কিন্তু বাধ্য হয়েছিল আইন করে পতাকা ওড়ানো বন্ধ করতে। জাতীয় সংসদে আইন পাস করেই দেশবাসীকে এই পতাকার বিষয়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছিল।
শিক্ষানীতির মতো দেশে একটি সুষ্ঠু ও সর্বজনগ্রাহ্য সংস্কৃতি নীতি সম্পর্কে অনেক লেখালেখি হয়েছে। সুধীজনেরা নানা ফোরামেও কথা বলছেন। কদিন আগে খবরের কাগজে প্রকাশিত একটি সংবাদ থেকে খানিকটা আশান্বিত হলাম। সরকারিভাবে না হলেও দলীয়ভাবে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার দেশের খ্যাতিমান একজন শিক্ষাবিদকে সভাপতি ও একজন দর্শকপ্রিয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে সদস্যসচিব করে একটি সংস্কৃতি উপকমিটি গঠন করেছে। ওই কমিটি দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নানা কৌণিকে পর্যালোচনা করে একটি সংস্কৃতি নীতিমালা প্রণয়নে সহায়তা করবে। নিউক্লিয়াস হিসেবে প্রণীত এই খসড়া সংস্কৃতি নীতিগুলোই বিভিন্ন পর্ব ও পর্যায় অতিক্রম করে জাতীয় সংস্কৃতি নীতি হিসেবে দেশবাসীর কাছে উপস্থাপিত হবে। এই প্রাথমিক উদ্যোগ নেওয়ায় বর্তমান সরকার অবশ্যই ধন্যবাদার্হ।
প্রতিটি দেশেরই সাংস্কৃতিক নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। কারণ, সেই ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর আত্মিক, বুদ্ধিগত, বস্তুগত, আবেগগত চিন্তা-চেতনা প্রকাশের স্বার্থেই এই সম্পর্কিত নিয়ম-নীতির প্রয়োজন। বলা হয়ে থাকে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের মাধ্যমেই একটি জাতি তার স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারে।
এই লক্ষ্যেই মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর ১৯৮২ সালের আন্তর্জাতিক কনভেনশনে সংস্কৃতিনীতি বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত সব সদস্যদেশকে স্বতন্ত্রভাবে সংস্কৃতিনীতি প্রণয়ন করতে হবে। আরও উল্লেখ করা হয়, সংস্কৃতির মাধ্যমেই মানুষ নিজেকে প্রকাশ করে, আত্মসচেতন হয়, নিজের অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে বোধ জন্মে, নিজের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে প্রশ্ন করতে শেখে, অনবরত নিজের সীমা অতিক্রম করে দক্ষতা অর্জন করে। কোনো একটি একক সংস্কৃতি তার সর্বজনীনতা বিস্তারের ক্ষেত্রে অনেক অন্তরায়। পৃথিবীর অন্যান্য সংস্কৃতির সঙ্গে তাকে সম্পর্ক গড়তে হবে এবং সেই সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে সে তার অস্তিত্ব প্রমাণ করবে। আদান-প্রদানের মাধ্যমে কেবল সর্বজনগ্রাহ্য সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি হতে পারে।
আমাদের দেশে সংস্কৃতিনীতি প্রণয়ন করতে গেলে ইউনেসকোর ঘোষিত এই তথ্যগুলো মাথায় রাখতে হবে তো বটেই। সংস্কৃতির বিষয়াবলি বহুমাত্রিক আমাদের দেশে। তেল, গ্যাস, জ্বালানি ও খাদ্যসংকটের মতো বড় বড় সমস্যা থাকলেও সংস্কৃতি নিয়ে ভাবনার প্রয়োজন অবশ্যই আছে। দেশে দ্রুত নগরায়ণ, তথ্যপ্রযুক্তির সর্বগ্রাস, পরিবেশের দ্রুত পরিবর্তন—জনগণের রুচি ও চাহিদার পরিবর্তনের কারণে এসব দিক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জাতি হিসেবে আমাদের আবহমানকালের ঠিকানা রক্ষা করার স্বার্থেই আমাদের দেশে সংস্কৃতিনীতি প্রণয়ন করা জরুরি।
আমাদের লোকঐতিহ্যের জনপ্রিয় শাখা যাত্রাশিল্প। ষোড়শ শতক থেকে শুরু হয়েছে এই বিনোদনমাধ্যমের চর্চা। প্রায় দুই শ যাত্রাদল রয়েছে দেশে। কলাকুশলী, যন্ত্রী, রূপসজ্জাকর মিলে লাখ ছয়েক লোকের জীবন এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৩৩ সালের লাইসেন্স এনডোরসমেন্ট অ্যাক্টের অব্যবস্থার কারণে গ্রামের মানুষের প্রিয় এই বিনোদনমাধ্যমটি এখন ধ্বংসোন্মুুখ। এই শিল্পকে রক্ষা করার উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের আরেক জনপ্রিয় বিনোদনমাধ্যম চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রশিল্পকে সর্বজনগ্রাহ্য করার নীতিও প্রণয়ন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটিজ অ্যাক্ট বাতিল করা প্রয়োজন দেশের চলচ্চিত্রের বিকাশের স্বার্থেই। বিশেষভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে চলচ্চিত্র বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এর সঙ্গে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সও সংযোজনের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন।
সাংস্কৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে দেশের বিদ্যমান আইনগুলো অত্যন্ত দুর্বল, এগুলোর আধুনিকায়ন দরকার। ঔপনিবেশিক আমলের আইনগুলোই এখন দেশে চালু রয়েছে। দেশের ঐতিহাসিক স্থানগুলোর পূর্ণাঙ্গ জরিপ এখনো হয়নি। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন অপরিহার্য প্রত্নপীঠগুলো ক্রমান্বয়ে কৃষিজমিতে রূপান্তরিত হওয়ার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে পুরাকীর্তির বিপুল সম্ভার। দেশের অনেক ঐতিহাসিক ইমারত সংরক্ষণ না করে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। অপরদিকে যেগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর মান নিয়ে অভিজ্ঞজনেরা প্রশ্ন তুলছেন, প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। এমন এক প্রতিবাদের মুখে সুলতানি বাংলার একসময়ের রাজধানী সোনারগাঁয়ের পানাম নগরের সংরক্ষণকাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। সাংস্কৃতিক নীতিমালা তৈরির সময় এদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি পাঠানোর সময়ও এই নীতিমালায় সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে হবে, বিশেষ করে সংগীত, নৃত্য, শিল্পকলা, চলচ্চিত্র, ভাষা-সাহিত্য, নাটক প্রভৃতি অঙ্গন থেকে কারা, কোন কোন বিবেচনায় দেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন, তারও ব্যাখ্যা থাকতে হবে। এসব বিষয়ে না থাকায় অতীতে দেখা গেছে বহির্বিশ্বে দেশের সঠিক সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব হয়নি। দেশের পুস্তক, প্রকাশনা ও বিপণনেও অনেক সমস্যা রয়েছে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা দূর করতে হবে। আমদানিকৃত পুস্তকের সম্ভার দেশের প্রকাশনাশিল্পের ক্ষতি সাধন করছে। আধুনিক প্রযুক্তির কারণে দ্রুতই সব বিদেশি বই পাইরেসি হয়ে বাজার সয়লাব করছে, এটাও আমাদের প্রকাশনাশিল্পে সংকট নিয়ে আসছে, এর নিয়ন্ত্রণ দরকার। দেশের প্রকাশনাশিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট জাতীয় সংস্থা গঠন করা যেতে পারে। আগে গঠিত এ ধরনের সংস্থা থাকলে তা যুগোপযোগী করতে হবে।
তবে সরকার ইতিমধ্যেই একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে। প্রথম পর্যায়েই ইনস্টিটিউটে একটি ভাষা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মিতব্য বারোতলা ভবনে আরও থাকবে আরকাইভস, গ্রন্থাগার, ভাষা গবেষণাকেন্দ্র প্রভৃতি। এখানে সুযোগ থাকছে বিদেশিদের বাংলা ভাষা শেখার। ভাষা ইনস্টিটিউটের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার সংযোজন। মনে রাখতে হবে, বিশ্বের ১৮ কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে যাচ্ছে এই ইনস্টিটিউট। নিঃসন্দেহে এটি বর্তমান সরকারের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে অন্যতম। সরকারের পক্ষ থেকে সোনারগাঁয়ের জাতীয় ফোকলোর ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার যে পরিকল্পনা রয়েছে, তার রূপরেখা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কৃৎকৌশল এই সংস্কৃতিনীতিতে লিপিবদ্ধ করতে হবে।
বর্তমান সরকার নির্বাচনী ইশতেহারে দেশের উন্নয়ন ও কল্যাণে যে রূপকল্প ২০২১-এর বাস্তবায়নের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন, সংস্কৃতিনীতি প্রণীত হলে তার অনেকখানিই যে পূরণ হবে, তা বলতে দ্বিধা নেই।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক, অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.