রাজনৈতিক আলোচনা- ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাজনীতি by হাসিবুর রহমান

রাষ্ট্র ক্ষমতা চর্চা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উৎপত্তি যুগপৎ আলোচনার বিষয়। কেননা যখনই রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানের উৎপত্তি হয়েছে তখন থেকেই ব্যবস্থাপনার বিষয় হিসেবে ক্ষমতা চর্চার বিষয়টি রাষ্ট্র ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে আলোচিত হয়ে এসেছে। এই অর্থে ক্ষমতা চর্চার ইতিহাস রাষ্ট্র ব্যবস্থার উৎপত্তির মতই পুরাতন। তবে ক্ষমতা চর্চা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় বিভিন্নভাবে হয়েছে।
কখনো কেন্দ্রাতিক আবার কখনোবা কেন্দ্রাভিক। ক্ষমতার ব্যবহার বা চর্চার বিষয়টি কেন্দ্রাতিক ও কেন্দ্রাভিক যা হোক না কেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ক্ষমতা কিভাবে চর্চিত হয়েছে বা হচ্ছে? ক্ষমতা চর্চা দুইভাবে হতে পারে ইতিবাচক ও নেতিবাচক। তাহলে ইতিবাচক কেন্দ্রাতিক ক্ষমতা চর্চা আবার নেতিবাচক কেন্দ্রাতিক ক্ষমতা চর্চা হতে পারে আবার হতে পারে কেন্দ্রাভিক ইতিবাচক ক্ষমতা চর্চা ও কেন্দ্রাভিক নেতিবাচক ক্ষমতা চর্চা। ক্ষমতা চর্চা ইতিবাচক, নেতিবাচক ও কেন্দ্রাতিক, কেন্দ্রাভিক যা হোক না কেন ডেবিট ইস্টনের ভাষায় ক্ষমতা চর্চা বলতে বুঝানো হয় সমাজের সম্পদের কর্তৃত্বপূর্ণ বরাদ্দ নিশ্চিত করা । এই অর্থে ক্ষমতা চর্চা বলতে বুঝানো হয় সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করা। সুষম বন্টনের বিষয়টি বলতে তিনি বুঝিয়েছেন যে যতটুকু প্রাপ্য সে অনুযায়ী বন্টন। সকলের জন্য সমান নয়। রাষ্ট্র চিন্তার বিবর্তনের ইতিহাসে রাষ্ট্র ক্ষমতার চর্চা এই চারভাবেই হয়েছে। সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সামন্ত প্রভুগণ তাদের ক্ষমতা প্রয়োগের সুবিধার্থে একটি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর সৃষ্টি করেছিলেন যাকে কেন্দ্রাভিক ক্ষমতার নেতিবাচক প্রয়োগ বলতে পারি। কেননা এই মধ্যস্বত্বভোগী গোষ্ঠীগণ সামন্ত প্রভুর বাণিজ্যিক প্রতিনিধি ছিলেন এবং বাণিজ্যকৃত মুনাফার অংশ বিশেষ সামন্ত প্রভুকে প্রদান করতেন। তখন রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চার বিষয়টিতে একটি বাণিজ্যিক ভাবধারা পরিলক্ষিত হয়েছিল। রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায়ও একই ভাবধারা পরিলক্ষিত হয়। কেননা রাজাগণ তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে ট্যাক্স ও খাজনা আদায় করতেন। এই প্রতিনিধিগণ রাজার বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে রাষ্ট্র ক্ষমতারও প্রতিনিধি বনে যান। ফলে রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায়ও রাষ্ট্র ক্ষমতার বাণিজ্যিক বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে ছিল। এমন কি গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও ক্ষমতা পুঁজির অধীন হয়ে গেছে। পুঁজি কেন্দ্রীভূত হওয়ার সাথে সাথে অর্থনৈতিক ক্ষমতা শেষাবধি রাজনৈতিক ক্ষমতায় রূপান্তর লাভ করে। তখন রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ঘটে এবং রাজনীতির মাপকাঠি হয়ে যায় অর্থনীতি। ক্ষমতা হয়ে যায় অর্থনীতির প্রতিভূ। তখন অর্থনীতি ও রাজনীতির সমন্বয় নতুন একটি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের সৃষ্টি হয়। নতুন এই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে রাজনীতি হয়ে যায় বাণিজ্যের একটি মাধ্যম। তখন পুঁজিপতিগণ রাজনীতিতে অর্থের বিনিয়োগ করেন। অর্থের বিনিয়োগ করে রাজনৈতিক ক্ষমতার মালিক হন। রাজনৈতিক ক্ষমতার মালিক হয়ে অর্থের পুনঃ উৎপাদন ঘটান। তখন অর্থনীতি ও রাজনীতির দোলাচলে রাজনীতি পরিণত হয় জুয়া খেলায়। রাজনীতি যখন জুয়া খেলায় পরিণত হয় তখন শুধু পুঁজিপতি নয়, অনেকেই জুয়া খেলায় বিনিয়োগ করে রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার আশায়। আজকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাবশালী অংশ হচ্ছে শিল্পপতি, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা অথবা যে কোনভাবে অর্জিত প্রভাব পতিপত্তির মালিক। এই প্রভাব-পতিপত্তির মালিকরা নির্বাচন সর্বস্ব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে নির্বাচিত হয়। নির্বাচিত হয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতিভূ হয়ে যায়। তখন এই রাজনৈতিক ক্ষমতাকে বিনিয়োগ করে পুঁজির উৎপাদন প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখে। তখন রাজনৈতিক ক্ষমতা হয়ে যায় ব্যক্তি পুঁজির অধীন। তখন রাজনীতির এই নেতিবাচক প্রভাব পরে তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। কেননা রাষ্ট্র তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই মূলত তার ক্ষমতা চর্চা করে। তখন প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকতার পরিবর্তে রাজনীতিকীকরণ ঘটে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চার বিষয়টি এই প্রেক্ষাপটেই বিবেচ্য। একজন ব্যক্তি দ্বিবিধ ক্ষমতার মালিক হয়ে হয়ে সে ভুলে যায় তার কাজ কোন্টি? ফলে তার যা করা উচিত নয় তা করে বসে। একই ধারার সম্প্রসারিত রূপ হিসেবে এটি ঘটতে থাকে অন্যান্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও। এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতেন দেশের সুনামধন্য শিক্ষাবিধগণ। আজকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগ হচ্ছে দলীয় বিবেচনায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে পড়ে কলুষিত এবং শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ হয় নষ্ট। রাজনীতির এই অধঃপতিত অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সাধারণ অর্থে ন্যায় বলতে যা বুঝানো হয় সেই ধরনের ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নয়। অর্থাৎ সাধারণ অর্থে ন্যায় বলতে আমরা যা বুঝি সেটি হচ্ছে মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের জয়, অনুচিতের বিরুদ্ধে উচিতের জয়, মন্দের বিরুদ্ধে ভালোর জয় ইত্যাদি। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পেস্নটো ন্যায় বলতে বুঝিয়েছেন যে যার জন্য যোগ্য তাকে সেটি দিয়ে দেয়াই হচ্ছে ন্যায়। অর্থাৎ রাজনীতিবিদ রাজনীতি করবে, বিচারপতি বিচার করবে, শিক্ষাবিদ শিক্ষা গবেষণা করবে এটাই স্বাভাবিক এবং এটিই ন্যায়। এর বিপরীতটি নয়।
================================
মাস্টারদা সূর্যসেন ও যুব বিদ্রোহ সাতাত্তর  রসভা নির্বাচন ২০১১: একটি পর্যালোচনা  ড. ইউনূস অর্থ আত্মসাৎ করেননি  প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ৩৯ বছর  স্বাধীনতাযুদ্ধের 'বিস্মৃত' কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধারা  আতঙ্কে শেয়ারবাজার বন্ধঃ বিক্ষোভ  আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম হয়েছে  মানবকল্যাণ আমাদের মন্ত্র  ট্রানজিট নিয়ে সবে গবেষণা শুরু  ভারতের একতরফা সেচ প্রকল্পঃ বাংলাদেশের আপত্তিতে বিশ্বব্যাংকের সাড়া  আমলাদের যাচ্ছেতাই বিদেশ সফর  সরকারের ব্যর্থতায় হতাশাঃ বিরোধী দলের ব্যর্থতায় বিকল্পের অনুপস্থিতি  ক্ষমতা ও গণতন্ত্র  পানি সংকট পানি বাণিজ্য  ২০১০ সালের অর্থনীতি কেমন গেল  গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে বাধা অনেক  কপাটে তালা দিয়ে কেন এই মৃতু্যর আয়োজন  বিজয়ের অর্থনীতি ও সম্ভাবনা  মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লক্ষ্মীর মুখোমুখি  একেই কি বলে আমলাতন্ত্র?  আত্মসমর্পণের সেই বিকেল  আমরা তাঁদের ভুলতে পারি না  সংবিধানের অনেক বক্তব্য পারস্পরিক সংঘাতমূলক  পরাশক্তির বিরুদ্ধে এক ‘ভবঘুরের’ স্পর্ধা  আবু সাঈদ চৌধুরীর ভাষণ দেওয়া হলো না  শুভ নববর্ষ ২০১১- দিনে দিনে বর্ষ হলো গত  এরশাদের বিচারে দুই দলেরই আগ্রহ কম  কিশোরদের সাদামাটা ফল  জিপিএ-৫ পেয়েছে আট হাজার ৫২ জন  এরশাদের বিচার হওয়া উচিত  ছোটদের বড় সাফল্য  প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাঃ পাস ৯২%, প্রথম বিভাগ বেশি  বাংলাদেশের বন্ধুঃ জুলিয়ান ফ্রান্সিস  নিষ্ফল উদ্ধার অভিযানঃ দখলচক্রে ২৭ খাল  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  ভ টিজিং : জরুরি ভিত্তিতে যা করণীয়  প্রতিশ্রুতির দিন  শোকের মাস, বিজয়ের মাস  চীনা প্রধানমন্ত্রীর পাক-ভারত সফর  দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীন মন্তব্য


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ হাসিবুর রহমান
শিক্ষক, রাজনীতি ও প্রশাসন বিভাগ

এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.