সংসদে আসে যে, ফ্রি গাড়ি চড়ে সে -জনপ্রতিনিধি by সোহরাব হাসান

আমাদের ‘মহান’ জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব জনকল্যাণে আইন প্রণয়ন করা হলেও সুযোগ পেলেই যে তাঁরা আত্মস্বার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট থাকেন, তার ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। যে সংসদ যত বেশি অপ্রতিনিধিত্বশীল, গণবিরোধী আইন প্রণয়নে সেই সংসদ তত বেশি সক্রিয়। জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্রের জয়যাত্রা শুরুই হয়েছিল কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ অনুমোদনের মধ্য দিয়ে। আর গণতন্ত্রের আরেক উদ্ধারকর্তা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ভোটারবিহীন অষ্টম জাতীয় সংসদে দুটি বিতর্কিত আইন পাস করেছিলেন। এক. ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা, দুই. সাংসদদের জন্য বিনা শুল্কে গাড়ি আমদানি। এর আগে সাংসদেরা এন্তার বদনাম কুড়ালেও গাড়ি-বাণিজ্য করার প্রথম সুযোগ করে দেন এরশাদই। সে সময়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের দুই সিপাহশালার আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সংসদে ছিল না। স্বভাবতই আশা করা গিয়েছিল, গণতান্ত্রিক আমলে সেই গণবিরোধী আইনটি বাতিল হয়ে যাবে। বাস্তবে তা হয়নি। বরং সরকারি ও বিরোধী দলের সাংসদেরা মিলেমিশেই শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করেছেন। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যুতে তাঁরা বিপরীতমুখী অবস্থান নিলেও বেতন-ভাতা বৃদ্ধি কিংবা শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানিতে পুরোপুরি ঐকমত্য। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ মাত্র নয় দিন স্থায়ী হওয়ায় সাংসদেরা গাড়ি-বাণিজ্য করার সুযোগ পাননি। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন এবং ২০০১ সালের ১ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সপ্তম ও অষ্টম সংসদও আইনটি বহাল রাখে এবং সদস্যদের গাড়ি-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে থাকে।
এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, অষ্টম জাতীয় সংসদের সদস্যরা ২৭৫টি বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ২৮০ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেছেন। বেশির ভাগ সাংসদ ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতিটি গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে।
আইনে আছে, আমদানি করা শুল্কমুক্ত গাড়ি তিন বছরের মধ্যে বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু আইনপ্রণেতারা সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছিল জনগণের সেবার জন্য। তাঁরা জনসেবা বাদ দিয়ে ব্যক্তিসেবাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সাংসদেরা ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে থাকতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নির্বাচনের পর তাঁরা যে শপথবাক্য পাঠ করেন তাতে স্পষ্ট লেখা আছে—
‘আমি...সংসদ সদস্য, নির্বাচিত হইয়া সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে আমি যে কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে যাইতেছি, তাহা আইন অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব; আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; এবং সংসদ সদস্যরূপে আমার কর্তব্য পালনকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হইতে দিব না।’
সাংসদদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ দিয়ে পূর্ববর্তী সরকারগুলো অবৈধ গাড়ি-বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়েছিল। কাজটি ভালো হয়নি তা প্রধানমন্ত্রীও বুঝতে পেরেছেন। এ কারণে তিনি সরকারি গাড়ি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। এটা কতটা জরুরি সেটাও ভাবতে হবে। কিংবা সরকারি খরচে গাড়ি বিতরণ না করে সেই অর্থ কি জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা যেত না? আমাদের সাংসদেরা নির্বাচনের আগে সম্পদের যে হিসাব বিবরণী দিয়েছেন, তাতে প্রমাণিত হয় না যে তাঁরা গরিব। বর্তমান সংসদে অধিকাংশ সদস্য ধনী ও ব্যবসায়ী। নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া পাঁচ লাখ টাকায় নির্বাচন করেছেন এমন একজনকেও পাওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে সরকার কেন তাঁদের ফ্রি গাড়ি দেবে? অধিকাংশ সদস্যের এক বা একাধিক গাড়ি আছে। সরকার ফ্রি গাড়ি দিলে তা নির্বাচনী এলাকায় জনগণের সেবায় ব্যবহূত হবে না, ব্যবহূত হবে সাংসদদের পোষ্য ও দলীয় কর্মীদের ব্যক্তিগত কাজে। সরকারি অর্থে কেন তা হবে?
প্রথমে স্পিকার প্রস্তাব করেছিলেন, শুল্কমুক্ত কোটায় বিলাসবহুল নয়, এমন গাড়ি আমদানি করার। গত জুনে সংসদ কমিশনের সভায় প্রধানমন্ত্রী সরকারি খরচে সব সাংসদকে গাড়ি কিনে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি প্রগতি ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে গাড়ি কেনার প্রস্তাব দেয়। গত ১৬ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্পিকারের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, সরকারি অর্থায়নে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারি পরিবহন অধিদপ্তরের মাধ্যমে গাড়ি আমদানি করে সাংসদদের সরবরাহ করা হবে।
সাংসদদের জন্য কেনা এসব গাড়ি হবে জিপ আকৃতির এবং সর্বোচ্চ তিন হাজার সিসির। প্রতিটি গাড়ির দাম ধরা হয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ লাখ টাকা (শুল্কমুক্ত)। সে ক্ষেত্রে সরকারের খরচ হবে ১৫০ কোটি টাকা এবং এসব গাড়ির শুল্ক আসবে (৫৯০ দশমিক ২৩ শতাংশ) আরও ৫৫০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে সরকারি খরচের পরিমাণ ৭০০ কোটি টাকা। জ্বালানি ও চালকের বেতন ধরলে আরও কয়েক কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, অষ্টম জাতীয় সংসদে ৩০০ আসনের মধ্যে ২২০টিরও বেশি পায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট, এরশাদের জাতীয় পার্টি ১৪ এবং আওয়ামী লীগ ৫৮টি। সে ক্ষেত্রে গাড়ি-বাণিজ্যে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরাই বেশি লাভবান হয়েছিলেন। এবার আওয়ামী লীগের সাংসদদের সংখ্যাই ২৬৮। তাঁদের ফ্রি গাড়ি দিয়ে মনে হচ্ছে, গতবারের বঞ্চনা পুষিয়ে নেওয়া হবে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কেন ৩৪৫টি গাড়ি কেনার কথা বলে স্পিকারের কাছে চিঠি লিখল? জাতীয় সংসদে ৩৪৫ জন সদস্য আছেন ঠিকই। কিন্তু তাঁদের মধ্যে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, চিফ হুইপ ও সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানেরা পদাধিকারবলেই গাড়ি পেয়ে থাকেন। একই ব্যক্তি সরকার বা রাষ্ট্র থেকে দ্বৈত সুবিধা নিতে পারেন না। যাঁরা মন্ত্রী বা অন্য কোনো পদে থেকে গাড়ির সুবিধা পান, তাঁরা কোন যুক্তিতে সাংসদ হিসেবে ফ্রি গাড়ি দাবি করবেন? এর আগে সরকার সাংসদদের নামে ন্যাম ফ্ল্যাট বরাদ্দ করেছিল নামমাত্র ভাড়ায়। তিন দশক ধরেই ‘উদ্বাস্তু’ সাংসদদের ‘মাথা গোঁজার ঠাঁই’ করে দেওয়ার জন্য প্লট বরাদ্দ করা হচ্ছে। তার পরও প্লট ও ফ্ল্যাটপ্রার্থীদের তালিকা ক্রমেই লম্বা হচ্ছে। আগের কথা না-হয় বাদই দিলাম, এ বছর যেসব সাংসদ উত্তরা ও পূর্বাচলে প্লট পেয়েছেন, তাঁদের কজন মাথায় হাত দিয়ে বলতে পারবেন, এই ঢাকা শহরে নিজের বা স্ত্রী-পুত্র-কন্যার নামে কোনো জমি বা ফ্ল্যাট নেই। অর্থাত্ ব্যক্তিস্বার্থে তাঁরা মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন। এ ধরনের জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে জনগণ কী আশা করতে পারে?
বাংলাদেশে যখন সব সরকারই দলীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে সাংসদদের বাড়ি-গাড়ি দিচ্ছে, তখন দেখা যাক অন্যান্য দেশের হাল কী? প্রতিবেশী দেশ ভারতে সাংসদদের (লোকসভা ও রাজ্যসভা) কোনো গাড়ি দেওয়া হয় না। তবে তাঁরা সরকারি খরচে বিমানে এক্সিকিউটিভ ক্লাসে ও ট্রেনে প্রথম শ্রেণীতে ভ্রমণ করতে পারেন। অন্যদিকে অধিবেশন চলাকালে সদস্যদের চাহিদার ভিত্তিতে রাজ্যসভা ও লোকসভা সচিবালয় থেকে গাড়ি সরবরাহ করা হয় তাঁদের বাসভবন থেকে আনা-নেওয়ার জন্য। এ জন্য তাঁদের প্রতিবার পাঁচ টাকা করে দিতে হয়।
মালয়েশিয়ার সাংসদেরা সরকারি কাজে বা বৈঠকে যোগ দিতে নিজের গাড়ি ব্যবহার করলেও প্রথম শ্রেণীর ভাড়া দাবি করতে পারেন। গাড়ির জন্য ব্যাংক ঋণ পেলেও বিনা মূল্যে গাড়ি পান না।
শ্রীলঙ্কায় সাংসদদের সরকারি খরচে বাড়ি, অফিস, নিরাপত্তারক্ষী ও স্টেশনারি দেওয়া হলেও গাড়ি দেওয়া হয় না। পাকিস্তানেও সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান ছাড়া অন্যরা গাড়ি পান না।
গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে পরিচিত ব্রিটেনে সাংসদদেরও গাড়ি দেওয়া হয় না। তাঁরা নির্দিষ্ট হারে বাড়িভাড়া পান। গত জুলাইয়ে কমন্স সভার বেশ কিছু সদস্য ভুয়া বাড়িভাড়া উত্তোলন করায় ব্যাপক হইচই হয়েছিল। যে কারণে স্পিকারকেও পদত্যাগ করতে হয়। ভারতেও দুর্নীতির দায়ে অনেক কেন্দ্রীয় ও মুখ্যমন্ত্রীকে জেল খাটতে হয়েছে। আর আমাদের দেশে দুর্নীতিবাজেরা বরাবরই ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে থাকেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বহুল আলোচিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানও বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরোয় পরিণত হয়।
সরকারি খরচে সাংসদদের গাড়ি দেওয়াকে অনেকে মন্দের ভালো বলেছেন। এতে অন্তত সাংসদদের অবৈধ গাড়ি-বাণিজ্য বন্ধ হবে। তার পরও বলব, সব সাংসদকে ফ্রি গাড়ি দেওয়ার যুক্তি নেই। বরং যাদের গাড়ি নেই তাদের গাড়ির জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই বলেন, জনগণ আমাদের কী দিয়েছে, সে চিন্তা না করে জনগণকে কী দিতে পেরেছি সেটাই ভাবতে হবে। কিন্তু সাংসদদের ফ্রি গাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্তে ‘জনগণকে কী দিতে পারি’ তার চেয়ে ‘জনগণ থেকে কী নিতে পেরেছি’ সেটাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
সাংসদদের প্রধান কর্তব্য আইন পাস করা, সংসদে গিয়ে জনগণের পক্ষে কথা বলা। নবম জাতীয় সংসদ শুরু হওয়ার পর প্রথম অধিবেশনে কয়েক দিন ছাড়া বিরোধী দল পুরো সময়টা গরহাজির থেকেছে। তার পরও বেতন-ভাতা নিতে রাষ্ট্রীয় অর্থে বিদেশভ্রমণ করতে অসুবিধা হয়নি। আমাদের সাংসদেরা নির্বাচনের আগে একনিষ্ঠ জনসেবক থাকেন, নির্বাচিত হওয়ার পর আত্মসেবক ও দলসেবক হয়ে যান। এই ‘দুরারোগ্য ব্যাধির’ উপশম কী?
সোহরাব হাসান: সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.