বাংলাদেশের জলবায়ু-শরণার্থী -চারদিক by মনিরুল আলম

বাংলাদেশের আবহাওয়া শেষ! এতটুকু বলেই আমার ছোট বোনটা দ্রুত জানালা বন্ধ করতে যায়। সবাই মিলে বসেছি দুপুরের খাবার খেতে, ঠিক তখনই শুরু হলো বৃষ্টি। অদিনে বৃষ্টি, সারাক্ষণ ভাপসা গরম আর বন্যা-খরা তো আছেই—জলবায়ু পরিবর্তনের এসব বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। বেশ কয়েক দিন পর পর মৃদু ভূমিকম্প হচ্ছে। বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। ভারসাম্যহীন হয়ে উঠছে পরিবেশ। এ জন্য দায়ী উন্নত বিশ্বের শিল্পবর্জ্য, তাদের লোভ-লালসার জন্য সৃষ্ট কর্মকাণ্ড।
সাধারণ মানুষ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে না গিয়েও খুব সহজে বুঝতে পারছে, আবহাওয়ায় বড় ধরনের একটা পরিবর্তন হচ্ছে। সাম্প্রতিক সিডর, আইলা, বন্যা, নদীভাঙন, খরা, অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ধসের ঘটনা আগের বছরগুলোর চেয়ে অনেক গুণ বেড়েছে—এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
বড় ফুফু দেশের বাড়িতে থাকেন। মুঠোফোনে যোগাযোগ করে বন্যা-পরিস্থিতির কথা বলছিলেন বেশ কিছুদিন আগে। একমাত্র নাতনিকে নিয়ে ঘরে বসে আছেন। চারদিকে বন্যার পানি। সপ্তাহখানেক এই পানির মধ্যে কাটাতে হয়েছে। তার ভাষ্যমতে, আগে এ রকম হয়নি। বন্যা হতো, তবে বাড়িতে পানি উঠত না। কয়েক বছর ধরে ঘরে পানি উঠছে। মাটি ফেলে ঘরভিটি উঁচু করার পরও পানি উঠছে। এখন কী করি, সামনের দিনগুলোতেই বা কেমনে বাঁচব আমরা—উদ্বিগ্ন আমার ফুফু!
জলবায়ুর এই পরিবর্তনে সাধারণ মানুষের করণীয়টা আসলে কী? ঢাকায় বসে যাঁরা এই জলবায়ু নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন, তাঁরাও কি বুঝতে পারছেন, আসলে করণীয়টা কী? বা আমরা কতটুকু করতে পারছি? প্রশ্ন অনেকভাবেই করা যায়, কিন্তু এর সমাধানটা কোথায় বা কোন সময়ে? কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের ক্ষতির পাল্লা ভারী হতে শুরু করেছে।
ঘরহারা, ভিটেহারা মানুষ এখন দলে দলে শহরমুখী হতে শুরু করেছে। কিন্তু এটা কি কোনো সমাধানের পথ হতে পারে, নাকি ভালোভাবে বেঁচে থাকার কোনো উপায় এটা? বিশ্বদরবারে ইতিমধ্যে আমরা নিজ দেশে জলবায়ু-শরণার্থী হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করেছি।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষের অসহায়ত্বই ফুটে উঠেছে। ধনী দেশগুলোর সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোর চলছে টানাপোড়েন। সমান তালে চলছে বিতর্ক, কে কতটুকু ছাড় দেবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আক্রান্ত দেশগুলোতে যে শরণার্থী তৈরি হবে, তা এই পৃথিবী আগে কখনো মোকাবিলা করেনি। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা এই জনপদের মানুষ নিজ প্রচেষ্টায় বেঁচে থাকার জন্য ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। এদের সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে। এর দায় আমরা কীভাবে এড়াব?
আবারও সেই দারিদ্র্য, সেই অনাহারক্লিষ্ট ক্ষুধার্ত জনপদ! হেলিকপ্টার থেকে খাদ্য ছুড়ে ফেলা কিংবা রিলিফের জন্য লম্বা সারি।
এ কথা ভাবলে শিউরে ওঠে বুক। কোপেনহেগেনের দিকে তাকিয়ে আছে এখন সারা বিশ্ব। কিন্তু শোনা যাচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশগুলো এই সম্মেলন থেকে কিছুই পাবে না।
পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে কোথায় চলে যাবে? পাহাড়ের ওপর থেকে বরফ গলে গলে সমৃুদ্রকে কি পাগল করে দেবে? কার্বন নির্গমন কারা করে, কতটা করে, আর তাতে ক্ষতি হয় কার? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর কি কারও জানা নেই? এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পরই লাখ লাখ মানুষ খাওয়ার পানি পাবে না আর। তখন শুধু বাঁচার তাগিদেই শুরু হবে অভিবাসন। মানুষের সেই বিপুল প্লাবন ঠেকাবে কে? উন্নয়নশীল বিশ্বের এ যুগের শিশুরা কি জানে, তাদের জন্য কী নির্মম ইতিহাস লেখা হচ্ছে?
ছবির বৃদ্ধটি যন্ত্রযানে একাকার মহানগরের এক উড়ালসেতুর ওপর নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছেন। সত্যি কি নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছেন? পথে বাড়তে থাকা শকটগুলো বলে দিচ্ছে, এখানে যে পরিমাণ কার্বন মনোক্সাইডের নির্গমন হচ্ছে, তার হাজার গুণ বেশি নির্গমন হচ্ছে উন্নত বিশ্বে। তারই খড়্গ এসে কেটে নেবে উন্নয়নশীল দেশের সব সুখ। বাংলাদেশ কি শুধু কেঁদেই যাবে? ঘুরে দাঁড়াবে না আরেকবার? ঘুরেফিরে সেই প্রশ্নই আমি নিজেকে করি...

No comments

Powered by Blogger.