সরকারি কলেজে স্নাতক শ্রেণীর ভর্তি : ২য় মেধা তালিকা প্রকাশে রাখঢাক- চাঁদা না দিলে মেধা তালিকায় স্থান পেয়েও ভর্তির সুযোগ নেই by আমানুর রহমান

সারা দেশে সরকারি কলেজগুলোতে নীরব চাঁদাবাজি করছে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। কলেজ ভেদে এই হার একেক রকম। এ চাঁদা দেয়া না হলে মেধা তালিকায় স্থান পেয়েও শিক্ষার্থীরা ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন না সরকারি কলেজে। গত বুধবার দ্বিতীয় মেধা তালিকা প্রকাশে রাখ-ঢাক করছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ।
উচ্চশিক্ষার সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীতে ভর্তির আগেই বাধ্য হয়েই নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত এ চাঁদা দিতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। দেশের সব ক’টি সরকারি কলেজের ভর্তিতে এখন এ আস্থা বিরাজ করেছে। এটি চলবে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীতে ভর্তির সময় শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত। সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীতে ভর্তির প্রথম মেধা তালিকা প্রকাশ করেছে। তাদের ভর্তি কার্যক্রম এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে তৃতীয় মেধা তালিকা প্রকাশ করবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সরকারি কলেজগুলোতে ভর্তি ফরম নেয়া, ভর্তির জন্য ব্যাংকের বুথে টাকা জমা এবং ব্যাংকের রশিদ নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগে ভর্তির সময়ও বাধ্যতামূলক চাঁদা দিতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এসব অঘোষিত ও রশিদবিহীন চাঁদা না দিলে কোনো শিক্ষার্থীকেই ভর্তির সুযোগ দেয়া হচ্ছে না সরকারি কলেজগুলোতে। এর প্রতিবাদ করতে গেলে বড় ভাইদের (ছাত্রলীগ কর্মীদের ঘুষি ও থাপ্পড়ের) রোষানলে পড়তে হচ্ছে ভর্তি হতে ইচ্ছুক নবীন শিক্ষার্থীদের। কারো কারো ভর্তির ফরমও কেড়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রথম মেধাতালিকা অনুসারে গত ১৯ জানুয়ারি থেকে ভর্তিকার্যক্রম শুরু হয় সরকারি কলেজগুলোতে। দ্বিতীয় মেধাতালিকা থেকে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ভর্তিকার্যক্রম শুরু হবে। প্রথম মেধাতালিকায় ভর্তির সময় রাজধানীর কবি নজরুল সরকারি কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ঢাকা কলেজ, বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, তিতুমীর সরকারি কলেজে সরেজমিন পরিদর্শনকালে উপরোক্ত চিত্র পাওয়া গেছে। ব্যাংকের কলেজ বুথে ব্যাংক কর্মচারীরা টাকা আদায় করছেন ভর্তির নির্ধারিত ফি, আর একই বুথে আগে চাঁদার টাকা দিতে হচ্ছে, তারপর ভর্তি ফি দেয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এ টাকা আদায় করছে ছাত্রলীগের স্থানীয় শাখার কর্মীরা।
এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কলেজের অধ্যক্ষ এবং স্থানীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের সাথে আলাপকালে তারা কেউ এ ব্যাপারে প্রকাশ্য মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি  জানিয়েছেন নয়া দিগন্তকে। ব্যাংক কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারি কলেজের ভর্তি বা পরীক্ষার ফি জমা নিতে একাধিকবার অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তারা। তাদের কর্মকর্তারা কলেজ বুথে দায়িত্ব পালন করতে চান না। কর্মকর্তাদের প্রায়ই অসংলগ্ন ও অশোভন আচরণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েও কোনো ফল হচ্ছে না। কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বুথ প্রত্যাহার করতে চাইলেও সম্ভব হচ্ছে না।
গত ১৮ জানুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষের প্রথমবর্ষ স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীর ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকাশিত প্রথম মেধাতালিকায় ১ লাখ ৯৯ হাজার ১৭০ জন শিক্ষার্থীকে আসন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় মেধাতালিকায় কতজনকে আসন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা প্রকাশ করা হয়নি। এরপর আসন শূন্য থাকাসাপেক্ষে পরে তৃতীয় মেধাতালিকা প্রকাশ করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ বছর বিভিন্ন বিষয়ে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৩৭৫ জন শিক্ষার্থী স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীতে ভর্তির সুযোগ পাবে। সারা দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সরকারি স্নাতক কলেজের সংখ্যা হচ্ছে ২৭৫টি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, গত বুধবার দ্বিতীয় মেধাতালিকা প্রকাশ করা হয়েছে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। কিন্তু তা সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয়নি। এ ব্যাপারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এ তালিকা প্রকাশে ভাইস চ্যান্সেলরের অনুমতি পাওয়া যায়নি। তাই সংবাদমাধ্যমকে গতকাল পর্যন্ত জানানো হয়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দ্বিতীয় মেধাতালিকা দেয়া হয়েছে।
পুরান ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজ এবং সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে ভর্তিকার্যক্রম সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, জনতা ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের লক্ষ্মীবাজার শাখায় ওই দু’টি কলেজের ভর্তির টাকা জমা নেয়া হয়। এখানেই ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যাবতীয় আর্থিক লেনদেন হয়ে থাকে। কবি নজরুল কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যেই জনতা ব্যাংকের বুথ রয়েছে। ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী বুথে অবস্থান করলেও এর নিয়ন্ত্রণ ছাত্রলীগের কলেজ শাখার সক্রিয় জনা-চারেক কর্মীর হাতে। বুথে বসে তারা প্রথমে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দু’শ করে টাকা আদায় করে স্ক্রল নাম্বার দিচ্ছেন, তার পর ওই ফরম ব্যাংকের কর্মচারীদের হাতে দিচ্ছেন নির্ধারিত ভর্তি ফি’ আদায় ও জমা নেয়ার জন্য। এর আগে ভর্তি ফরম সংগ্রহের সময়ও ছাত্রলীগের নজরদারি ও খবরদারি বাইরে কেউ যেতে পারছে না। ভর্তি ফি জমা দেয়ার পর এবার নতুন এ শিক্ষার্থী তার সংশ্লিষ্ট বিভাগে গিয়ে ভর্তির ফরমের জমা রসিদ দেখালে সেখানেও তাকে সেমিনার ফির সাথে অতিরিক্ত ৫০ টাকা হারে রসিদ ছাড়া জমা দিতে হচ্ছে। এখানে বিজ্ঞান অনুষদের বিভিন্ন বিভাগে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের ৩ হাজার ২৫২ টাকা এবং ব্যবসায় শিক্ষা ও কলা অনুষদের জন্য ৩ হাজার ৫২ টাকা জমা দিতে দেখা গেছে।
দেশের অন্যতম বড় কলেজ রাজধানীর মহাখালীর তিতুমীর কলেজেও একই অবস্থা দেখা গেছে, এখানে ভর্তি ইচ্ছুকদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে ১ শ’ টাকা করে। এ টাকারও কোনো রসিদ নেই। এর কোনো প্রতিবাদ বা রসিদ চাওয়ার কোনো সাহস নেই নতুন শিক্ষার্থীদের। ঢাকার বাইরে সরকারি কলেজগুলোতে একই চিত্র বলে জানা গেছে।
কবি নজরুল সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক আহমেদ সাজ্জাদ রশিদ নয়া দিগন্তকে বলেন, রসিদবিহীন টাকা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া এ ব্যাপারে তিনি অধ্যক্ষের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন।
কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. নুরুন নাহার গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি জানেন না। এ ব্যাপারে কোনো অভিভাবক বা শিক্ষার্থী এ পর্যন্ত অভিযোগ করেননি। তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার কোনো ফোর্স দেয়নি। আমাদের করার কিচ্ছু নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ভর্তি নেয়া হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের যেকোনো ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা জমা দেয়ার পদ্ধতি চালু করা হলে আমরা ঝামেলা মুক্ত থাকতে পারি।’
কবি নজরুল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল হাসান সোহেল নয়া দিগন্তকে বলেন, এ ধরনের অভিযোগের কথা আমি শুনেছি। তবে আমরা এখন ব্যস্ত রয়েছি অবরোধ-হরতাল প্রতিরোধে। চাঁদা আদায়ের বিষয়টি স্বীকার করলেও এর সাথে ছাত্রলীগ জড়িত নয় বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের নাম ভাঙিয়ে যারা এসব করছে তারা ছাত্রলীগের কেউ নয়। তিনি তার সাথে পুরো কলেজ ঘুরে দেখার প্রস্তাব করেন এবং কারা করছে তাদের দেখিয়ে দেয়ার পরামর্শ দেন।

No comments

Powered by Blogger.