দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন হিসাব-নিকাশ by মোহাম্মদ এজাজ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভারত সফর এবং একই সঙ্গে মোদি সরকারের সঙ্গে রাশিয়া, চীন, জাপান, ইসরায়েলসহ পরাশক্তিগুলোর ঘনিষ্ঠতা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা নিয়ে নতুন হিসাব-নিকাশ হাজির করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে বিশ্বজুড়ে আমেরিকার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক একচ্ছত্র আধিপত্য সৃষ্টি হয়েছিল ঠিকই; কিন্তু একই সময়ে চীন, ভারতও বিশ্বের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে শক্ত অবস্থান, একশ' কোটির অধিক জনসংখ্যার অপার সম্ভাবনাময় বাজার ভারতকে বিশ্বদরবারে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে এসেছে। অন্যদিকে বর্তমানে বিশ্বের 'এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি' চীনও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে তার চার হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। আর পারমাণবিক শক্তিধর হওয়া ছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগস্থল হওয়ায় পাকিস্তান আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, তেল-গ্যাস পাইপলাইনের ক্ষেত্রে কৌশলগত দিক থেকে সুবিধাজনক স্থানে রয়েছে। এই তিন দেশের বিদেশনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে থাকছে যুক্তরাষ্ট্র।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আন্তর্জাতিক পরিসরে আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্ব্বী না থাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যবসা-বাণিজ্য ও তার আদর্শিক অবস্থান পুঁজিবাদী চিন্তা-চেতনার প্রসার এত দ্রুত বিস্তার লাভ করে যে, দুনিয়ার প্রায় সব অঞ্চলে তার একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা মনে করতে থাকে, কোনো আঞ্চলিক উন্নয়ন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা মার্কিন আদলেই হতে হবে। ভিন্ন মত ও পথের কোনো অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক শক্তি তার নিজ দেশের এবং ওই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে দেখে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে 'গণতান্ত্রিক, নিরাপদ ও উন্নত' করতে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তিকে নিয়ে নানা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক মৈত্রী ও কৌশলে আবদ্ধ হয়ে থাকে। কিন্তু এশিয়ায় চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক উত্থান, ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের জের, ইউক্রেন সংকট, চীনের আগ্রাসী অর্থনৈতিক ও সামরিক নীতি প্রভৃতি কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে খুব হিসাব করে এগোতে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো আন্তর্জাতিক কর্তৃত্বের অভিলাষ না থাকলেও ভারত নিজেকে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক ও সামরিক চালিকাশক্তি হিসেবে দেখতে চায়। এজন্য প্রায় সব দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রাখতে চায়। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীনের সঙ্গে নিরাপত্তা কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। ভারত তার সামরিক সরঞ্জাম, গোলাবারুদ রাশিয়ার কাছ থেকে বেশি নিয়ে থাকে। ইসরায়েল ও ফ্রান্স দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানের সরবরাহকারী দেশ।
এর ভিত্তিতেই ভারত তার ঘরোয়া ও বিদেশ নীতি সাজিয়েছে। মনমোহন সিং ক্ষমতায় থাকাকালে সার্ক দেশগুলো, চীন, জাপান, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ ও বৈঠক করেছেন। অপরদিকে নরেন্দ্র মোদি পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর জোর দিয়ে ভারতকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যেতে চান। এগুলো হচ্ছে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, বিদেশি বিনিয়োগ, সামরিক শক্তি বৃদ্ধি, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা। সম্প্রতি মোদি সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রদবদল ও আগ্রাসী বৈদেশিক নীতি তারই বহিঃপ্রকাশ।
এখনও শীর্ষ পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রই কেবল পারে এই পাঁচটি বিষয়ে সহায়তা দিতে। অন্যদিকে বিনিয়োগ, বাণিজ্য সম্প্রসারণ, আঞ্চলিক নিরাপত্তা, বিশেষ করে চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতেও ভারতকে কাছে পাওয়া দরকার যুক্তরাষ্ট্রের। ভারতকে এ অঞ্চলের মোড়ল বানালে ফলত যুক্তরাষ্ট্রেরই লাভ এবং এখানকার আঞ্চলিক দেশগুলোর রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব ও নাক গলানো বস্তুত আমেরিকার নীতিরই সমর্থন। ভারত এখানে আমেরিকার পক্ষ হয়েই স্থানীয় অঞ্চলের বিদেশ নীতির বাস্তবায়ন করবে। ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে প্রকাশ্যেই এই অঞ্চলের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন দিয়ে দিয়েছে। শ্রীলংকার নির্বাচনে ভারত-মার্কিন যৌথ কূটনীতিক সমর্থনে রাজাপাকসের বিদায় ও নতুন সরকারের ক্ষমতায় আরোহণ এবং চীনের বিনিয়োগ বাদ দিয়ে ভারত ও মার্কিন বিনিয়োগের প্রতি নতুন সরকারের আগ্রহ সেই আভাসই দেয়।
চীনের সঙ্গেও ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুবই গভীর। বর্তমানে ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক সহযোগী চীন। সম্প্রতি ওয়েন জিয়াবাওয়ের ভারত সফরে চীন-ভারত দু'দেশের বাণিজ্যকে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পেঁৗছানোর জন্য একমত হয়েছেন। ভারত চীনের সঙ্গেও বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতার চুক্তিতে আবদ্ধ। ভারত ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক-সামরিক সহায়তা অনেক গভীর। প্রতি বছর এ দেশগুলোর সঙ্গে ২০ বিলিয়নের অধিক বাণিজ্য করে থাকে চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে রকম ভারতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ সহায়তা করছে ঠিক তেমনি পাকিস্তানের পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন চীনের সহায়তায় হচ্ছে, যা কি-না পরবর্তীকালে উভয় দেশের মিলিটারি, বিশেষ করে সামরিক নিরাপত্তা সরঞ্জাম তৈরিতে কাজে লাগবে। দক্ষিণ এশিয়ার ছোট-বড় দেশগুলোতে বিশেষ করে বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, নেপালকে কম সুদে অর্থনৈতিক সহায়তাও চীন দিয়ে থাকে। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, নেপালের সামরিক সরঞ্জামের অন্যতম বৃহৎ জোগানদাতাও চীন। অতিসম্প্রতি পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে চীনের সামরিক সরঞ্জামাদির অতিমাত্রায় সহায়তার জন্য দিলি্ল তার আপত্তি উত্থাপন করেছে। এদিকে দিলি্লর যুক্তরাষ্ট্র, জাপানের মিলিটারি সহযোগিতা নেওয়ায় চীনও উদ্বেগ জানিয়েছে।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানেরও দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত ও সবচেয়ে বড় ট্রেডিং পার্টনার। পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান মধ্য এশিয়া, ইরান, ভারত ও চীনের সঙ্গে সরাসরি হওয়ায় এর বাণিজ্যিক, সামরিক ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে আমেরিকার সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক অপরিহার্য। ন্যাটোভুক্ত দেশ না হয়েও পাকিস্তান একটি প্রধান ন্যাটো সহযোগী দেশ। এ অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের যেমন নিরাপত্তা অংশীদারিত্বের সম্পর্ক বিদ্যমান এরকম কাছাকাছি সম্পর্ক এ অঞ্চলে মার্কিনিদের সঙ্গে আর কারও নেই ।
এমন জটিল পরিস্থিতিতে ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাশিয়া ভারতের অনেক পুরনো বন্ধু এবং ভারতীয় মিলিটারির সবচেয়ে বড় রসদ সাপ্লাইয়ার। আর ওবামা চান এবার ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে দেখা রুশ অস্ত্রগুলোর জায়গায় মার্কিন অস্ত্র আসুক। প্রধানমন্ত্রী মোদি মার্কিনিদের এই প্রত্যাশা কীভাবে মেটাবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। চীনকেও ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে এবং সেটা সহজ নয়। সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়া এখন এক 'গেম চেঞ্জিং' পর্যায় অতিক্রম করছে। সব পক্ষই ব্যস্ত নতুন হিসাব-নিকাশে।
গবেষক
ezazbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.