শ্রদ্ধাঞ্জলি- ইতিহাসের নতুন দিগন্ত উন্মোচন by গোলাম মুরশিদ

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক তপন রায় চৌধুরী ২৬ নভেম্বর (২০১৪) রাতে তার অক্সফোর্ডের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বছরখানেক অসুস্থ থাকার পর। তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। কারও কারও মতে, ৯০ বছর। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন বরিশালের কীর্তিপাশা গ্রামে এক জমিদার পরিবারে। বড় হয়ে তিনি লেখাপড়া করেন কলকাতা আর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। হাজার হাজার বাঙালি ইতিহাস নিয়ে লেখাপড়া করলেও ইতিহাসচর্চায় বাঙালির বিশেষ অবদান আছে অথবা অবদান থাকলেও তা যে খুব গুরুত্বপূর্ণ, গত একশ' বছরের ইতিহাস থেকে তা মনে করা শক্ত। তবে যদুনাথ সরকার ইতিহাসচর্চায় যেমন পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিলেন, ইতিহাসের নতুন দিগন্ত উন্মোচনে তেমন অসাধারণ ভূমিকা রেখে গেছেন তার ছাত্র তপন রায় চৌধুরী। যদুনাথ সরকার সামাজিক ইতিহাসের নতুন ধারা প্রবর্তন করেছিলেন, তপন রায় চৌধুরী কেবল সামাজিক ইতিহাস নয়, সে সঙ্গে অর্থনৈতিক এবং মননশীলতার ইতিহাস রচনারও পথ দেখিয়ে গেছেন।
মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেন যদুনাথ সরকারের তত্ত্বাবধানে। সম্রাট আকবর ১৫৭৪ সালে তার সেনাপতি মুনিমকে পাঠিয়েছিলেন বঙ্গদেশ দখলে আনার জন্য। কিন্তু শত চেষ্টা করেও আকবরের ১০ জন সুবেদার বঙ্গদেশ পুরোপুরি অধিকার করতে পারেননি ১৬০৫ সাল পর্যন্ত। এ অঞ্চল সত্যিকারভাবে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় জাহাঙ্গীরের আমলে। বঙ্গদেশে মোগলদের সাম্রাজ্য বিস্তারের সেই আদিপর্বের সমাজ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন তপন রায় চৌধুরী, তার ডক্টরেটের জন্য। তার সেই গবেষণাভিত্তিক গ্রন্থের নাম ছিল 'বেঙ্গল আন্ডার আকবর অ্যান্ড জাহাঙ্গীর' (কলকাতা, ১৯৫৩)। এই গবেষণা তিনি কী গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন, তা বোঝা যায় এর জন্য তার ফারসি ভাষা শেখার ঘটনা থেকে। ফারসি শিখে তিনি সমকালীন দলিল-দস্তাবেজ এবং ঐতিহাসিক বিবরণ ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও তার কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না তিনি। সামাজিক ইতিহাস লেখার উন্নততর আদর্শে গ্রন্থটি দ্বিতীয়বার দিলি্ল থেকে প্রকাশিত হওয়ার সময় (১৯৬৯) তিনি দীর্ঘ একটি ভূমিকা লেখেন। তাতে তিনি তার অতৃপ্তির কথা জানান এবং এ ভূমিকায় দেখান কীভাবে পুরো গ্রন্থটি রচনা করা যেত।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট করার পর তিনি অক্সফোর্ডে যান দ্বিতীয়বার ডক্টরেট করার জন্য। এবার আর সামাজিক ইতিহাস নয়, গবেষণা করেন অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে। তার গবেষণার বিষয় ছিল_ সতেরো শতকে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির করোমণ্ডল অর্থাৎ তামিলনাড়ূর উপকূলে ব্যবসা-বাণিজ্য। এ কাজের জন্য তিনি ভালো করে ডাচ ভাষা শেখেন। তার এ অভিসন্দর্ভের ওপর ভিত্তি করে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় নেদারল্যান্ডসের হেগ থেকে, ১৯৬২ সালে। এই গ্রন্থের নাম 'ইয়ান কোম্পানি ইন করোমণ্ডল, ১৬০৫-১৬৯০।' দক্ষিণ ভারতের উপকূলে ডাচ-বাণিজ্যের রাজনৈতিক পটভূমি, সমস্যা, ব্যর্থতা এবং সাফল্য নিয়ে তিনি আলোচনা করেন এ গ্রন্থে। কর্মজীবনে তিনি কলকাতার মাওলানা আজাদ কলেজ, ন্যাশনাল লাইব্রেরি, দিলি্ল স্কুল অব ইকোনমিক্স, দিলি্ল বিশ্ববিদ্যালয় এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিলায়েল কলেজে কাজ করেন। এ ছাড়া কয়েক বছর আগে তিনি ভারতের জাতীয় গবেষণা অধ্যাপক নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং আমৃত্যু সে পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধি পান। আর ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পান পদ্মভূষণ।
তপন রায় চৌধুরী ইতিহাসচর্চা শুরু করেছিলেন সামাজিক ইতিহাসের পথ ধরে। তখনকার বঙ্গদেশে যদুনাথ সরকার ছাড়া অন্য কেউ এ পথে হাঁটেননি। তারপর তপন রায় চৌধুরী এগিয়ে যান অর্থনৈতিক ইতিহাসের পথে। দুটিই পণ্ডিতি কাজ। কিন্তু এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। এরপর তিনি তুলে নেন মননশীলতার ইতিহাস রচনার কাজ, যে কাজ আরও সূক্ষ্ম, আরও জটিল, আরও বিশ্লেষণাত্মক। তার এ নতুন পথের প্রথম ফসল হলো 'ইউরোপ রিকনসিডার্ড' (১৯৮৮)। এ গ্রন্থে তিনি উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে শিক্ষিত হিন্দু বিশিষ্টজনরা কীভাবে ইউরোপকে নতুন দৃষ্টিতে দেখেছিলেন তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ আলোচনা করার জন্য তিনি উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের তিনজন প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিকে বেছে নিয়েছিলেন_ ভূদেব মুখোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং বিবেকানন্দ। চিন্তাধারার দিক দিয়ে এ তিন বিখ্যাত ব্যক্তি একে অন্যের থেকে যথেষ্ট আলাদা। কিন্তু তিনজনই জাতীয়তাবাদী। তিনজনই তাদের হিন্দু পরিচয় সম্পর্কে অতি সচেতন। তাই পাশ্চাত্য ধারণা দিয়ে তারা যতই প্রভাবিত হোন না কেন, তিনজনই নিজেদের ভারতীয় পরিচয় অক্ষুণ্ন এবং জাগ্রত রাখার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। স্বভাবতই তাদের ইউরোপ দর্শনে এক ধরনের সাদৃশ্য আছে। অন্য পক্ষে, সমাজের যে অংশ পাশ্চাত্যকে বিনা দ্বিধায় অনুকরণীয় আদর্শ বলে গ্রহণ করেছিল, সে অংশ পাশ্চাত্যকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেছিল কি-না অথবা দেখে থাকলে সে দৃষ্টিভঙ্গিতে সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কোনো বিবর্তন হয়েছিল কি-না তা বোঝার উপায় থাকে না।
এর ১০ বছরেরও পর প্রকাশিত হয় তার 'পারসেপশন, ইমোশন্স, সেনসিবিলিটিজ : ইন্ডিয়াস কলোনিয়াল অ্যান্ড পোস্ট-কলোনিয়াল এক্সপেরিয়েন্সেজ।' নাম থেকেই বোঝা যায়, এ বইয়ের দৃষ্টিবিন্দুতে কোনো একটি সুনির্দিষ্ট বিষয় নেই। আসলে তিনি বিশ শতকের শেষ দশকে যেসব প্রবন্ধ লিখেছিলেন, এ গ্রন্থ হলো তার সংকলন। তবে এ বিচিত্র বিষয়বস্তুকে তিনি ঔপনিবেশিকতা এবং উত্তর-ঔপনিবেশিকতার সূত্র দিয়ে বাঁধতে চেষ্টা করেছেন। ব্রিটেনের প্রভাব এবং ব্রিটেন সম্পর্কে বঙ্গদেশের পরিবর্তনশীল দৃষ্টিভঙ্গিই এ গ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু। 'ইউরোপ রিকনসিডার্ড' গ্রন্থে স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে লেখার পর এ গ্রন্থে তিনি স্বামীজি সম্পর্কে নিজের আরও ভাবনাকে প্রকাশ করেন অনেকটা 'পুনশ্চ'র মতো। সাম্প্রদায়িকতা যে ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠছে এবং তা জাতীয় পরিচয়কে আবিল করে তুলছে, এটা তার উদার দৃষ্টিভঙ্গিকে আহত করেছিল। সে জন্য হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গ এসেছে একাধিক প্রবন্ধে। তবে বিশেষ করে 'স্বস্তিকার ছায়া : হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে' প্রবন্ধে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। উনিশ শতকে ধর্ম সম্পর্কে মনোভাবে যে বিবর্তন ঘটে, সে সম্পর্কে আলাদা করে একটি প্রবন্ধ আছে। একাধিক প্রবন্ধ আছে ঔপনিবেশিক শাসন বিষয়ে। তার মধ্যে একটির নাম 'রাজ রিকনসিডার্ড'। পুরনো ধারণাগুলোকে নতুন করে মূল্যায়ন করা এবং ফিরে দেখার মনোভাব এ গ্রন্থে আগাগোড়াই জোরালো। রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীজিকে বাদ দিয়ে ইংরেজ রাজত্বের কথা আলোচনা করা এক রকম অসম্ভব। তাই এ দুই যুগান্তকারী ব্যক্তিত্বও বারবার এসেছেন এ গ্রন্থে। উনিশ শতকে যুক্তিবাদ এবং লিবারেলিজম শিক্ষিত সমাজের একাংশকে আলোকিত করেছিল_ সে নিয়েও তিনি আলোচনা করেছেন। তার চিন্তা একান্তভাবেই তার নিজস্ব এবং সেখান থেকে সরতে তিনি রাজি নন। তাই তার বিশ্লেষণ এবং বক্তব্যের সঙ্গে সর্বত্র একমত হওয়া সম্ভব নয়, স্বাভাবিকও নয়, কিন্তু তার বক্তব্য পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে।

No comments

Powered by Blogger.