মৌমাছির ভয়ে স্কুল বন্ধ- কী শিক্ষা দিতে চায়?

সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দলের ডাকা টানা হরতাল-অবরোধে এসএসসি পরীক্ষার সময়সূচি কেবল নয়, বিদ্যালয় পর্যায়ে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমও বিঘি্নত হচ্ছে, আমরা জানি। লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার কালীরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস থেকে শিক্ষা কার্যক্রমে যে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে, তার জন্য দায়ী অবশ্য বিরোধী দলের কর্মসূচি নয়। মঙ্গলবার সমকালের লোকালয় পাতায় প্রকাশিত প্রতিবেদনসূত্রে জানা যাচ্ছে, ওই বিদ্যালয় ভবনের চারপাশে অন্তত ২৫টি চাক বেঁধেছে মৌমাছি। বিদ্যালয়ের দপ্তর, শ্রেণীকক্ষ_ সবখানেই তাদের উচ্ছল উপস্থিতি। ফলে মৌমাছির ভয়ে যে বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতি বেড়ে গেছে, তাতে দোষ দেওয়া যায় না। মৌমাছি যদিও পরিশ্রম, শৃঙ্খলা ও অধ্যবসায় শিক্ষার অনন্য উদাহরণ এবং মধুর মতো মিষ্টি খাদ্য উপাদানের উৎস হলেও এর হুল মোটেও প্রীতিকর নয়, বলা বাহুল্য। অতিরিক্ত সংখ্যায় মৌমাছির আক্রমণে মৃত্যুর অঘটনও ঘটতে পারে। অবশ্য মৌমাছি উত্ত্যক্ত না হলে সাধারণত বিবাদে জড়াতে চায় না। সমকালের প্রতিবেদনে যদিও বলা হয়েছে যে বিদ্যালয়ের মৌমাছিগুলো 'আশেপাশে মানুষ পেলেই কামড়ে দিচ্ছে।' এমন ঢালাও অভিযোগ অবলা পতঙ্গটির বিরুদ্ধে অবিচারই হতে পারে। দেশ-বিদেশে এখন পর্যন্ত যত গবেষণা হয়েছে, কোথাও পতঙ্গটির মাথা গরম হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বলা হয়নি যে পতঙ্গটি বিনা কারণে অন্যদের আক্রমণ করে থাকে। তারা সাধারণত বাসস্থান তৈরি, বংশবৃদ্ধি ও মধু সংগ্রহেই নিমগ্ন থাকে। এসব ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা এলেই কেবল চড়াও হয়। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ বাক্সে মৌমাছি পালন। অনেক সময় গ্রামবাংলার কোথাও কোথাও বাসগৃহেও মৌমাছি মৌচাক তৈরি করে। অন্য বাসিন্দারা উৎপাত না করলে, সহাবস্থানে কিন্তু সমস্যা হয় না। কিন্তু মানুষ ও মৌমাছির এই সহাবস্থানের নজির একটি বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হোক, সেটা আমরা কোনোমতে চাইব না। এই কারণে নয় যে মৌমাছির বিপুল উপস্থিতি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে বিরূপ রেখাপাত করতে পারে; এই কারণে যে এতে করে শিক্ষার্থীদের আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপক ঝুঁকি থেকে যায়। আমরা চাই, প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের 'কাজের লোক' কবিতা থেকেই মৌমাছির নিয়ম-শৃঙ্খলা ও সময়ানুবর্তিতা শিখুক। একই শিক্ষা লাভ করুক বিদ্যালয়টির পরিণত শিক্ষকমণ্ডলী ও পরিচালনা পরিষদ। ওই বিদ্যালয়ে চার বছর ধরে হেমন্ত ও শীত মৌসুমে মৌমাছি এসে বাসা বাঁধছে এবং বছরের পর বছর তার সংখ্যা বাড়িয়ে চলছে; অথচ তারা স্কুল কার্যক্রমে শিথিলতার মধ্য দিয়েই দায় সেরেছেন! এটা স্পষ্ট যে তারা নিয়ম ও শৃঙ্খলার ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। যদিও প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট নানা কারণে মৌমাছির সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান, গ্রামবাংলায় জনবসতিতে মৌমাছির আগমন ও অবস্থান নতুন নয়। জননিরাপত্তা বিবেচনায় তা তাড়িয়ে দেওয়ারও রয়েছে বিভিন্ন প্রাচীন পদ্ধতি। সেগুলো প্রয়োগ না করে কেন বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঊর্ধ্বতনদের পরিদর্শন ও তদন্তের অপেক্ষায় আছে, আমরা তাতে বিস্মিত! আমরা দেখতে চাইব, অবিলম্বে মৌমাছি সরিয়ে বিদ্যালয়টিতে শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়েছে। একইসঙ্গে এ ঘটনা যাতে অন্যরা সতর্কতাবার্তা হিসেবে গ্রহণ করে, সে আহ্বানও রাখতে চাই। এও মনে রাখা জরুরি, দেশে বনজঙ্গল ক্রমে কমে যাওয়ার কারণেই মৌমাছি বাধ্য হচ্ছে লোকালয়ের কাছাকাছি ঘর বাঁধতে। মৌমাছিসহ অন্যান্য পশুপাখি ও কীটপতঙ্গের স্বাভাবিক আবাসস্থলও যে টিকিয়ে রাখা কতটা জরুরি কালীরহাটের 'বেরসিক' মৌমাছি সেই শিক্ষাও কিন্তু দিয়ে যেতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.