মা জানেন না, সাদিয়া নেই by রুদ্র মিজান

ইডেন মহিলা কলেজে ভর্তি হওয়া আর হলো না ইফফাতুজ জোহরা সাদিয়ার। ইডেন কলেজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শনিবার ভর্তি হওয়ার কথা ছিলো মেধাবী এই ছাত্রীর। কিন্তু তার আগেই দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে না ফেরার দেশে চলে গেছেন তিনি। একই ঘটনায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তার মা ফৌজিয়া বেগম। তিনি এখনও জানেন না যে, তার একমাত্র মেয়েটি আর বেঁচে নেই। কেন, কারা সাদিয়াকে হত্যা করেছে এ বিষয়ে কোন ধারণা নেই তার পরিবারের সদস্যদের। তবে একাধিকবিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। শনিবার নিহতের লাশের ময়নাতদন্ত শেষে গ্রামের বাড়ি শরিয়তপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ছিলো সাদিয়ার। এসএসসি ও এইচএসসিতে কৃতিত্বের  স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। জিপিএ-৫ পেয়েছেন দুটি পরীক্ষাতেই। যে কারণে মধ্যবিত্ত পিতা টেনেটুনে সংসার চালালেও একমাত্র কন্যার লেখাপড়ায় কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে দেননি। মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার জন্য পরীক্ষাও দিয়েছিলেন সাদিয়া। কিন্তু উত্তীর্ণ হতে পারেননি। তাই বলে স্বপ্ন ভেঙে যায়নি তার। সাদিয়া তার বাবাকে বলেছিলো, আব্বু, আমি আবার পরীক্ষা দেব। আমাকে ডাক্তার হতেই হবে। এরমধ্যেই ইডেন মহিলা কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দেন। ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র নিহতের ভাই জোবায়ের আহমেদ সাব্বির বলেন, শনিবার ছিল তার ভর্তি হওয়ার দিন। অথচ শনিবারে সে লাশ হয়ে মর্গে পড়ে আছে। আমার বোনতো আর কোনদিন ডাক্তার হতে পারবে না। কি অপরাধ কলেছিলো আমার বোন, ওরা আমার বোনকে মারলো কেন?
সাব্বিার জানান, তার বোনকে কেউ উত্ত্যক্ত করতো- এরকম কিছু তাদের জানা নেই। এমনকি তাদের কোন শত্রু নেই, যে তার বোনকে এভাবে হত্যা করতে পারে। একই কথা বলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তার খালাতো ভাই মুরাদ হোসেন। তিনি জানান, সাদিয়া ছিল ভীরু প্রকৃতির। একই ঘটনায় আহত সাদিয়ার মা ফৌজিয়া বেগম ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল শাহজাহানপুরে চিকিৎসাধীন। তার অবস্থা আশঙ্কা মুক্ত না বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। ঘটনার পরপর দুর্বৃত্তদের বিষয়ে শুক্রবার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে কয়েকটি বাক্য বিনিময় করেছেন ফৌজিয়া বেগম। ফৌজিয়া বেগমের বরাত দিয়ে তার বোনের ছেলে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে কর্মরত ফয়সল আহমদ জানান, ডিশ লাইন চেক করার কথা বলে তিন দুর্বৃত্ত বাসায় প্রবেশ করে। তাদের সঙ্গে থাকা ক্যাবল দিয়ে ফৌজিয়া বেগমকে বাঁধার চেষ্টা করে তারা। এ দৃশ্য দেখে ভয়ে চিৎকার করার চেষ্টা করলে সাদিয়াকে ছুরিকাঘাত করে দুর্বৃত্তরা। একই সময়ে ফৌজিয়াকেও তারা আঘাত করে। এছাড়া বাসায় থাকা সাদিয়ার নানী জোবেদা বেগমকে ভয়ভীতি দেখিয়ে জিম্মি করে দুর্বৃত্তরা। ফয়সল জানান, ফৌজিয়া বেগম সুস্থ হলে সঠিক তথ্য জানা যাবে বলে তিনি মনে করেন। গোলাপবাগের ৬/২ নম্বর বাড়িতে মা-বাবা ও ভাইদের সঙ্গে থাকতেন সাদিয়া। শনিবার সকালে ওই বাড়িতে গেলে দেখা যায় তৃতীয় তলায় তাদের ভাড়া বাসাটি তালাবদ্ধ রয়েছে। কথা হয় দ্বিতীয় তলায় থাকা বাড়ির মালিক খুরশেদ আলম মীরের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রায় ১১ বছর ধরে তৃতীয় তলার ওই ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে থাকেন সাদিয়ার পিতা আবু ইউসুফ। তিনি ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে কর্মরত। একজন ভদ্র, নিরীহ লোক। তার তিন সন্তানই মেধাবী। তাদের কোন শত্রু আছে বলে জানা নেই খুরশেদ আলম মীরের। তিনি বলেন, বাড়ির মূল ফটকসহ বাসার প্রতিটি ছোট গেট সবসময় তালাবদ্ধ থাকে। দুর্বৃত্তরা মিথ্যা কথা বলে ওই বাসায় ঢুকেছিলো। তখন বাড়ির প্রায় সকল পুরুষ মানুষই জুমার নামাজ পড়তে বাইরে ছিলেন। এই সুযোগে দুর্বৃত্তরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এ ঘটনায় নিহতের মামা মাজহারুল ইসলাম বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের আসামি করে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অবনী শংকর কর বলেন, সাদিয়া হত্যাকাণ্ডকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড তদন্ত করা হচ্ছে। গত শুক্রবার জুমার নামাজের সময় দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে সাদিয়া নিহত হন। একই ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন সাদিয়ার মা ফৌজিয়া  বেগম। ওই সময়ে সাদিয়ার ছোট ভাই খালিদ বিন ওয়ালিদ ইপ্তিকে নিয়ে তার পিতা আবু ইউসুফও জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে ছিলেন। তার বড় ভাই জোবায়ের আহমেদ সাব্বির ছিলেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। নিহত সাদিয়া তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা মাতুয়াইল মহিলা ক্যাম্পাস থেকে এসএসসি ও মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন সাদিয়া। দুটি পরীক্ষাতেই তিনি জিপিএ-৫ অর্জন করেন। তাদের গ্রামের বাড়ি শরিয়তপুর জেলার ঢামুডা উপজেলার গড়োয়া গ্রামে।

No comments

Powered by Blogger.