ধারণক্ষমতার তিন গুণ বন্দী কারাগারে- প্রতিদিন বাড়ছে কয়েক হাজার; খাদ্য, পানি, টয়লেটের তীব্র সঙ্কট by মনির হোসেন

দেশজুড়ে কারাগারগুলোতে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। সরকারবিরোধী আন্দোলন দমাতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর পাইকারি গ্রেফতার অভিযানের সুবাদে এসব কারাগারে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ঢাকাসহ প্রায় সব ক’টি করাগারেই ধারণ ক্ষমতার চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বন্দী রাখা হয়েছে। গ্রেফতারি প্রক্রিয়ায় আন্দোলন থামাতে বিগত ৬ জানুয়ারি থেকে বন্দীদের মুক্তি দেয়া না হলেও প্রতিদিনই সারা দেশে কয়েক হাজার নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। কারাগারগুলোর সর্বশেষ পরিসংখ্যানে জানা গেছে, দেশের ৬৮টি কারাগারে সর্বমোট ধারণক্ষমতা ২৭ হাজার হলেও বর্তমানে সেগুলোতে রাখা হয়েছে কমপক্ষে ৭১ হাজার বন্দী। কারা কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা মতে এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বন্দী সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এ ব্যাপারে তাদের প্রস্তুতির পরামর্শ দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট জায়গা থেকে। সূত্র মতে, এরই মধ্যে কারাগারগুলোতে খাদ্য, চিকিৎসা, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ১০০ হাজতির কক্ষে রাখা হয়েছে ৪০০। টয়লেটগুলো ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে অনেক আগেই। ফলে মারাত্মক পরিবেশও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বন্দীদের অধিকাংশই নির্ঘুম রাত্রিযাপন করছে। একজনের শোয়ার জায়গায় আছেন ৫ থেকে ৭ জন। অনেকেই বাধ্য হয়েই পালাকরে ঘণ্টা হিসাবে কোনোমতে ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। তার ওপর রয়েছে মশার সীমাহীন উপদ্রব। অনেক কারাগারে তাঁবু টানিয়ে তাতে বন্দী রাখা হয়েছে।
ভয়াবহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পরিস্থিতি
গণ ধরপাকড়ের কারণে এ কারাগারে ধারণক্ষমতার তিন গুণেরও বেশি বন্দী অবস্থান করছে বর্তমানে। এখানে ধারণক্ষমতা দুই হাজার ৬৮২ জন হলেও গতকাল পর্যন্ত রয়েছে সাত হাজার ৪১৯ জন। এ ছাড়াও প্রতিদিন এখানে নতুন যুক্ত হচ্ছে আরো ৩০০ থেকে ৪০০ বন্দী। নতুন বন্দীরা আমদানি সেলে যাওয়ার পর প্রধান কারারক্ষীর মনোনীত রাইটাররা বিভিন্ন দামে তাদের কিনে নিচ্ছেন। এরপর খবর দেয়া হচ্ছে তাদের স্বজনদের। কারা কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত বন্দীর চাপ সামলাতে সপ্তাহের দুই দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে কাশিমপুর কারাগারে বন্দী স্থানান্তর করা হচ্ছে। তার পরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে কর্তৃপক্ষ হিমশিম খাচ্ছে। এ কারাগারে মানবিক বিপর্যয়ের শিকার এসব বন্দী রাতে ঠিকমতো ঘুমানোর জায়গা না পেয়ে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন সেলে ‘ইলিশ ফাইলে’ রাত কাটাচ্ছেন। এতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বলে কারা সংশ্লিষ্ট সূত্রে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ দিকে আদালত সুত্রে জানা গেছে, গত ৬ জানুুয়ারি থেকে ঢাকার সিএমএম আদালতের অধীনে যতগুলো ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট রয়েছে, কোনো কোর্ট থেকেই হরতাল-অবরোধসংক্রান্ত মামলার বিষয়ে জামিন আবেদন বিবেচনা করা হচ্ছে না।
গতকাল শনিবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সরেজমিন খোঁজ নিতে গেলে দেখা যায়, গণগ্রেফতারের শিকার বন্দীর সাথে স্বজনেরা দেখা করতে সকাল থেকে কারাগারের সাক্ষাৎ কক্ষে ভিড় করেন। দূর দূরান্ত থেকে আসা নারী, পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধসহ শত শত মানুষকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা দেখা যায়। কারাগার সংশ্লিষ্ট কারারক্ষীদের যারা বেশি টাকা দিতে পারছে তারা মুখোমুখি দেখা করতে প্রধান গেটে লাইন ধরতে দেখা গেছে। কারাগারের আশপাশে বন্দীর স্বজনদের সাথে একাধিক কারারক্ষী প্রধান গেট দিয়ে দেখা করাতে এক হাজার ৫০০ টাকা করে দাবি করছে। যারা দিতে রাজি হচ্ছে তাদের অনায়াসে দেখা করানো হচ্ছে। এর মধ্যে কারারক্ষী মনির এ প্রতিবেদককে বন্দীর স্বজন মনে করে বলেন, প্রধান গেট দিয়ে মুখোমুখি দেখা করতে চাইলে এক হাজার ৫০০ টাকা দিতে হবে। কম টাকা নেয়ার আবেদন করলে তিনি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, এর কমে আর কোনো কারারক্ষীই প্রধান গেট দিয়ে দেখা করাতে পারবে না।
কারাগারের প্রধান গেটসংলগ্ন উল্টো পাশে বৃদ্ধ জয়নালসহ দু’জন বসে আছেন। পরিচয় গোপন রেখে বসে থাকার কারণ জানতে চাইলে জয়নাল এ প্রতিবেদককে বলেন, ছেলে ভেতরে। তার সাথে দেখা করতে এসেছি। তবে সে কোন সেলে আছে তা আমি জানি না। তাই ২০০ টাকা দিয়ে কারারক্ষীদের কাছ থেকে সিলিপ কেটেছি। এখন অপেক্ষা করছি। বেলা ২টা থেকে নাকি সাক্ষাৎ শুরু হবে। বৃদ্ধ জয়নাল তার ছেলে গ্রেফতার হওয়ার ব্যাপারে দাবি করে বলেন, আমার ছেলে বিবিএতে পড়ছে। গত পরশু গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছে। মিরপুরের বাড়িতে যাওয়ার পথে পুলিশ তাকে সন্দেহজনক আটক করে। পরে ৫৪ ধারায় মামলা দিয়ে আদালতে পাঠিয়েছে বলে শুনেছি। তার ছেলের নাম আনিসুর রহমান। পুলিশ তাকে বলেছে, সে এখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছে। এ জন্য দেখা করতে এলাম। পাশে বসা থাকা আরেক বন্দীর স্বজন ইসলামপুরের বাসিন্দা। তার নাম তিনি না জানিয়ে বলেন, কারাগারের ভেতরের অবস্থা এখন খুবই খারাপ। আমার বন্দী দেখা করতে এসে আমাকে বলেছে ভেতরে টয়লেটের পাশে অনেক বন্দীকে এখন রাত কাটাতে হচ্ছে। এর মধ্যে অনেক সেল আছে যেগুলোতে বেশির ভাগ বন্দীকে ‘ইলিশ ফাইলে’ ঘুমাতে হচ্ছে। ‘ইলিশ ফাইল’ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি সেলে যেখানে ৫০ জন আসামি থাকতে পারে সেখানেই এখন ২০০-৩০০ বন্দীকে থাকতে হচ্ছে। উপায় নেই। জায়গা কম। বন্দী বেশি। বাধ্য হয়ে ইলিশ মাছের মতো এককাত হয়ে রাতে ঘুমাতে হচ্ছে তাদের। এ সময় দুই দিকের চাপে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। কী আর করার।
কারা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে মনিহার, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমাসহ বেশ কিছু সেলে অতিরিক্ত বন্দী অবস্থান করছে। এরআগে যখন বন্দীদের আমদানী ওয়ার্ডে নেয়া হয় তখন প্রধান কারারক্ষী কাউছারের মনোনীত রাইটাররা (যাজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি) নতুন বন্দীদের কিনে ফেলে। এরপর তারা প্রতি সপ্তাহের জন্য উল্লিখিত সেলে তিন হাজার ৬০০ টাকা, ৯০ সেলে থাকার জন্য ৬০০০ টাকা, আর মেডিকেলে থাকার জন্য ১০ হাজার টাকা ও খাবারের অতিরিক্ত টাকা স্বজনদের কাছ থেকে আদায় করছে বলে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত রাতে আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করে কারাগারে বন্দী ধারণক্ষমতার কথা জানতে চাইলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, দুই দিনের কথা বলতে পারব না। তবে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারা দেশে বন্দীর সংখ্যা ছিল ৭১ হাজার। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী বেড়ে কি করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার এ দুই দিন কিছু বন্দীকে ঢাকা অন্যান্য কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দীর সাথে স্বজনদের দেখা সাক্ষাতে নগদ টাকা আদায় করা হচ্ছে এমন অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আমার জানা নেই।
এ দিকে আমাদের আদালত প্রতিবেদক মো: শহীদুল্লাহ মিঞা জানান, গত ৯ জানুয়ারি পুরান ঢাকার হাজারীবাগ এলাকা থেকে ৬৫ বছরের বৃদ্ধ হেমায়েত উদ্দিনকে পুলিশ ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে। পরদিন তাকে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তার জামিন আবেদন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। একইভাবে গত ৮ জানুয়ারি নবাবগঞ্জ বারোয়াখালী উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হারুনুর রশীদকে পুলিশ তার স্কুল থেকে তাকে গ্রেফতার করে। তিনি ওই দিন এসএসসি পরীক্ষার্থীদের নিয়ে মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করলেও মামলার এজাহারে তার নাম উল্লেখ করেনি। তারপরও আদালত তার জামিন না মজ্ঞুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, গত ৬ জানুয়ারি হাইকোর্ট এলাকায় একটি ভাঙচুরের মামলায় শাহবাগ থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া আইনজীবী অ্যাডভোকেট আজমত হোসাইন আদালত থেকে জামিন পাননি। আদালত তার জামিন আবেদন বিবেচনা করেননি। জামিন না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে শহীদুল্লাহ মিঞা বলেন, ৫ জানুয়ারির পর থেকে এ পর্যন্ত সিএমএম আদালতের অধীনে যতগুলো ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট রয়েছে এর মধ্যে কোন কোর্টে হরতাল অবরোধসংক্রান্ত মামলার বিষয়ে জামিন বিবেচনা করা হচ্ছে না। তবে পরিবেশ শান্ত হলে তারপর জামিন দেয়া হবে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, কাশিপুর হাই সিকিউরিটি সেলে ধারণক্ষমতা আছে ১ হাজার ২০ জনের। সেখানে বর্তমানে আছে ১ হাজার ৪০০ জন। কাশিমপুর কারাগার পার্ট-১ এ ধারণক্ষমতা আছে ৩০০ কিন্তু সেখানে আছে ১ হাজার ২০ জন। সিনিয়র জেল সুপার মিজানুর রহমান গতরাতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.